গত ৩১ আগস্ট ২০২১ তারিখ দিবাগত রাতে ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহণের একটি বাস রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছার পর দুর্ধর্ষ ডাকাতির কবলে পড়ে বাসটি। উক্ত বাসে যাত্রীবেশী থাকা ডাকাত দলের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে বাসের চালক মনজুর হোসেন (৫৫) গুরুতর আহত হয় এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে। উক্ত ঘটনায় বাসের সুপারভাইজার মোঃ পইমুল ইসলাম বাদী হয়ে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ গত ১ সেপ্টেম্বর থানায় পেনাল কোডের ৩৯৬/৩৯৭ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে।
উক্ত ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়। ঘটনাটি র্যাবের নজরে আসলে, এই চাঞ্চল্যকর হত্যাসহ ডাকাতির প্রেক্ষিতে র্যাব-১ তাৎক্ষনিকভাবে হত্যাকারী ডাকাত দলের সদস্যদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে দ্রæততার সাথে ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
র্যাবের তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ র্যাব-১ ও র্যাব-১৩ এর চৌকস দল রাজধানীর অদূরে আশুলিয়া ও গাইবান্ধা অভিযান পরিচালনা করে উক্ত হত্যাসহ ডাকাতির সাথে সরাসরি জড়িত মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো-১) শ্রী নয়ন চন্দ্র রায় (২২), পিতা-শ্রী সুশীল চন্দ্র রায়, জেলা-গাইবান্ধা, ২) মোঃ রিয়াজুল ইসলাম @ লালু (২২), পিতা-মৃত রাজ্জাক আলী, জেলা-গাইবান্ধা, ৩) মোঃ ওমর ফারুক (১৯), পিতা-মোঃ আনোয়ার, জেলা-গাইবান্ধা, ৪)
মোঃ ফিরোজ কবির (২০), পিতা-মোঃ আবু বকর, জেলা-গাইবান্ধা, ৫) আবু সাঈদ মোল্লা (২৫), পিতা-মোঃ আব্দুর রউফ, জেলা-গাইবান্ধা এবং ৬) শাকিল মিয়া (২৬), জেলাঃ গাইবাদ্ধা। এ সময়গ্রেফতারকৃতদরে নিকট হতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ৫টি ছুরি, লুটকৃত ১টি মোবাইল ফোন এবং তাদের ব্যবহৃত ৫ টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র্যাব। গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উক্ত হত্যাসহ ডাকাতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
অতঃপর বাসটি আনুমানিক ২.৩০ ঘটিকায় গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বিটিসি মোড় অতিক্রম করার পর বাসে যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে বাসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রথমে বাসের চালক মনজুর হোসেনকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় চালক বাসটি ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করলে তারা আবার চালকের কাঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা।
এরপর ডাকাত দলের সদস্য রিয়াজুল ইসলাম @ লালু বাসটি চালাতে থাকে এবং ডাকাত দলের অন্যান্য সদস্যরা বাসে লুটপাট করতে করতে রংপুরের শটিবাড়ীস্থ ভাবনা ফিলিং স্টেশনে ইউটার্ন করে পূনরায় উল্টো পথে রওয়ানা করে। পলাশবাড়ী পৌঁছার আগে ডাকাতেরা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে পীরগঞ্জের চম্পাগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে রাত আনুমানিক ৩ ঘটিকার দিকে যাত্রীসহ বাসটি রেখে পালিয়ে যায়।
এ সময় ডাকাতেরা যাত্রীদের মুঠোফোন এবং নগদ আনুমানিক ৩০/৪০ হাজার টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে বাসের যাত্রীরা গুরুতর আহত অবস্থায় বাসের চালক মনজুর হোসেনকে নিকটস্থ পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
র্যাব জানায় গ্রেফতারকৃত আসামীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। এই সংঘবদ্ধ ডাকাত দলটির সদস্য প্রায় ১০/১২ জন। গ্রেফতারকৃত আসামী নয়ন চন্দ্র রায় এই ডাকাত দলের মূল হোতা। সে এই ডাকাত দলটিকে নিয়ন্ত্রন করত। এই ডাকাত দলের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবত উত্তরবঙ্গগামী বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। তারা গত ডিসেম্বর ২০২০ হতে এখন পর্যন্ত ৭/৮ টি বাসে ডাকাতি করেছে বলে জানায়।
ইতোপূর্বে এই ডাকাত চক্রটি পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ ৪৮ কিলোমিটার এলাকা গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ রত্না স্পেশাল, ১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ সটিবাড়ি স্পেশাল, ১২ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ সৈকত পরিবহন, ৮ মার্চ ২০২১ তারিখ শ্যামলী পরিবহন, ৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখ জায়দা পরিবহন এবং ১৯ আগস্ট ২০২১ ডিপজল পরিবহনে ডাকাতি করছে মর্মে স্বীকার করে। সাধারণত তারা পলাশবাড়ি হতে পীরগঞ্জ মহাসড়কের নির্জন এলাকা বাস ডাকাতির জন্য বেছে নেয়। ডাকাতি করার পর তারা পুনরায় আশুলিয়ায় ফিরে আসে।
এদিকে নয়ন চন্দ্র রায়কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে উক্ত অপরাধী চক্রের মূল হোতা। চক্রের সদস্যরা আশুলিয়ায় বিভিন্ন গার্মেন্টসে খন্ডকালীন চাকুরী, ক্ষুদ্র ব্যবসা অটো চালক ইত্যাদি পেশায় জড়িত ছিল। শাকিলসহ আরও কয়েকজন সদস্য গাইবান্ধার বিভিন্ন পেশায় জড়িত। রিয়াজুল ইসলাম @ লালু পেশায় একজন ট্রাক চালক। সে তার অন্যান্য সহযোগীদের সাথে বাস ডাকাতি করার সময় বাসের চালকের পরিবর্তে নিজে বাস চালিয়ে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যেত। গ্রেফতারকৃত শাকিল ডাকাতি স্থলে উপস্থিত থেকে তথ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য সদস্যরা স্বশরীলে ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে। একে অপরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল মর্মে স্বীকার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে র্যাব।