মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কুড়িগ্রামে সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় জড়িত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সহকারী কমিশনার) রিন্টু বিকাশ চাকমাকে লঘুদণ্ড দিয়েছে সরকার।
‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী তাকে এ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলায় ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী আনা ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে একই বিধিমালার ৪(২) (খ) বিধি অনুযায়ী তার পরবর্তী বেতন বাড়ানোর প্রাপ্যতার তারিখ থেকে তিন বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বাড়ানো স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হলো। ভবিষ্যতে তিনি এর জন্য কোনো বকেয়া বেতন-ভাতা প্রাপ্য হবেন না।
রিন্টু বিকাশ চাকমা গত ১৩ মার্চ দিনগত রাতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুই/তিনজন অ্যাক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫ থেকে ১৬ জন আনসার সদস্য নিয়ে দরজা ভেঙে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাসায় প্রবেশ করেন বলেও উল্লেখ করা হয়।
সাংবাদিক আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া যায় এবং তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের জেল দেওয়া হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ভ্রাম্যমাণ আদালত/অভিযান রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ অ্যাক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের যথেচ্ছভাবে পরিচালিত হওয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।
এতে আরও বলা হয়, অভিযান পরিচালনাকালে এবং পরবর্তী সময়ে রিন্টু চাকমা সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। অভিযান পরিচালনাকালে আরিফুল ইসলামকে আটক করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং শাস্তি দেওয়ার পর গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ/অন্য কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি বিধায় অভিযান সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলে হয়, প্রসিকিউশন পক্ষ তথা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও রিন্টু চাকমা গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং অভিযান পরিচালনা সম্পন্ন হওয়ার দীর্ঘ প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর আগের তারিখ দিয়ে অভিযোগনামায় প্রসিকিউশন পক্ষের সই নেন। ফলে তার এ ধরনের কার্যক্রম এ অভিযান পরিচালনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং গৃহীত কার্যক্রম আইনসম্মত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রসিকিউশন পক্ষের অনুপস্থিতির পরও রিন্টু চাকমা টাস্কফোর্স পরিচালনা করেন এবং পরবর্তীকালে নিয়োগ করা অ্যাক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আরিফুল ইসলামকে সাজা দেন। এক্ষেত্রে টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকলে নিয়মিত মামলা দায়ের হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। পক্ষান্তরে গভীর রাতে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা বিধিসম্মত হয়নি, যার দায়-দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না।
‘সেই পরিপ্রেক্ষিতে রিন্টু বিকাশ চাকমার এ কর্মকাণ্ড ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৩ এর (খ) বিধি মোতাবেক ‘অসদাচরণ’ এর দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী তার কাছে পাঠানো হয়। ‘
রিন্টু চাকমা লিখিত জবাব দেন এবং ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নেন। ব্যক্তিগত শুনানি শেষে অভিযোগ তদন্তে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত বোর্ড গঠন করা হয়। তদন্ত বোর্ড তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওযার কথা জানানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, রিন্টু চাকমাকে চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ বা অন্য যথোপযুক্ত গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য একই বিধিমালা অনুযায়ী তাকে দ্বিতীয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তার জবাব পর্যালোচনার পর ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী চাকরি থেকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরামর্শ নেওয়া হয়। পিএসসি রিন্টু বিকাশ চাকমাকে ‘চাকরি হতে বরখাস্তকরণ’ গুরুদণ্ড দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে পরামর্শ দেয়। ’
চাকরি থেকে বরখাস্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রিন্টু বিকাশ চাকমার চাকরির বয়স, নবীন কর্মকর্তার বিষয় বিবেচনা করে তাকে শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী প্রস্তাবিত চাকরি হতে বরখাস্ত করার গুরুদণ্ডের পরিবর্তে তিন বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বাড়ানো স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হয়।