এ ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি টিকার ট্রায়ালের ব্যাপারে দেশে তোড়জোড় শুরু হয়েছে, যদিও এ ক্ষেত্রে ট্রায়ালের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। এর একটি হচ্ছে চীনের আইবিক্যাম এবং আর দুটি হচ্ছে কিউবার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের একদল বিশেষজ্ঞ মিলে একটি ন্যাজাল টিকা তৈরির সম্ভাবনাও এগিয়ে চলছে। তবে গবেষকরা বলছেন, সবটাই নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর।
এদিকে বাংলাদেশে এখন সংক্রমণ কমতির দিকে থাকা এবং টিকার জোগান বেড়ে যাওয়ায় এক ধরনের স্বস্তির দেখা মিললেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবারও সংক্রমণ ধীর ধীরে বাড়তির দিকে। ফলে টিকা নিয়েও নতুন করে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। বিশেষ করে গেল দুই সপ্তাহে অন্তত ছয়টি টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ও ভারতের বায়োটেক যৌথভাবে ন্যাজাল ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের একই সঙ্গে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু করে দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে কোডাজেনিক্স নামে একটি নতুন টিকার প্রথম ধাপের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। যুক্তরাজ্যে শুরু হয়েছে স্ক্যানসেল নামে একটি টিকার প্রথম ধাপের ট্রায়াল। পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সের শিশুদের উপযোগী ফাইজারের টিকার একটি ছোট সংস্করণ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া একটি নতুন টিকার প্রথম ট্রায়াল শুরু করেছে। রাশিয়ায় আগেরগুলো ছাড়াও নতুন আরো একটি টিকার ট্রায়াল শুরু করেছে গেল সপ্তাহে। ইরানের রাজি ভ্যাকসিন ও সেরাম ইনস্টিটিউট মিলে একটি টিকার তৃতীয় ধাপ শুরু করেছে গত সপ্তাহ থেকে। থাইল্যান্ড মহিদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিকার দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত টিকার ট্রায়াল বা দেশে উৎপাদন শুরু করতে না পারার বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপের (নাইট্যাগ) এক সিনিয়র সদস্য বলেন, ‘সরকার এখন টিকা জোগানে গতি দেখে যেভাবে স্বস্তির ভাব দেখাচ্ছে, তা মোটেই সুখকর নয়। যদি করোনা বিদায় করা এতটাই সহজ হতো, তবে এখনো বিশ্বের বড় বড় দেশ নতুন নতুন টিকার ট্রায়াল নিয়ে পড়ে থাকত না। এখনো দেড় শটির বেশি টিকার বিভিন্ন পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে দেশে দেশে। এ ছাড়া আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত যে চারটি টিকা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও এ দেশে কোনো ট্রায়াল করা হয়নি। অথচ বেশির ভাগ দেশই নিজের দেশে এসব টিকার ছোট বা বড় আকারে ট্রায়াল করেছে।’
ওই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘আমাদের হাতে কয়েক দফা কয়েকটি টিকার ট্রায়ালের সুযোগ এসেছিল, যা আমরা হাতছাড়া করেছি। কিন্তু এখনো সময় আছে, এখন যে কয়টি ট্রায়ালের সুযোগ আছে, সেগুলো লুফে নিয়ে ট্রায়াল শুরু করা উচিত। এতে সামনে আমাদের টিকার জোগান ও উৎপাদন অনেক সহজ হয়ে যাবে। অন্য দেশে হাত পেতে বসে থাকার প্রয়োজনও কমে যাবে।’
টিকা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিজ্ঞানী ও সম্প্রতি ম্যাগসেসাই পুরস্কার পাওয়া ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘আমরা কয়েকটি টিকার ট্রায়াল নিয়ে এগিয়ে গিয়েও বিভিন্ন কারণে তা কোনোটি বাতিল হয়ে গেছে আবার কোনোটির কাজ থেমে ছিল। এখন আবার এর মধ্যেই দু-তিনটির কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই একাধিক টিকার ট্রায়াল আমরা শুরু করতে পারব। এর মধ্যে একটির ফাইল এখন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।’
ওই বিজ্ঞানী বলেন, ‘চীনের একটি টিকার ট্রায়ালে কৌশলগত কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে আইবিক্যামের টিকার ট্রায়ালের ক্ষেত্রে আমরা প্লাসিবো ব্যবহার করব না। ট্রায়ালের আওতায় থাকা সবাইকেই সরাসরি টিকা দেব। চীনের কম্পানিটি সেভাবেই আগের প্রটোকল পরিবর্তন করে আমাদের পাঠিয়েছে। আমরা তা এখানে বিএমআরসি ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি। তারাও সেগুলো পর্যালোচনার পর মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।’
এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় পর্যায় থেকেও অনুমোদনপ্রক্রিয়া এগিয়ে সেটি আরো ওপরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছে। সেটি হয়ে গেলেই দেশে এর ট্রায়াল শুরু করে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে ওই টিকা দেশে আমদানি এবং দেশের একটি কম্পানিতে সেটি উৎপাদনেরও সুযোগ তৈরি হবে।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, এর আগে কিউবার একটি টিকা বাংলাদেশে ট্রায়ালের পথে অনেক দূর এগিয়েছিল। সেই টিকাটি এখন কিউবায় দুই বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানে নানা জটিলতার মুখে সেটি থেমে গিয়েছিল। এখন আবার সেটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। আশা করা যায়, ওই টিকাটি সরকারের অনুমোদন নিয়েই এখানে ট্রায়াল করা যাবে।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে এখন পর্যন্ত যে কয়টি টিকা দেওয়া হচ্ছে, সব কটিই প্রথম জেনারেশনের। কিন্তু উন্নত অনেক দেশে এই টিকাগুলোরই সেকেন্ড জেনারেশন দেওয়া শুরু হয়েছে। এটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়া আমাদের এখানে অবশ্যই বৈশ্বিক টিকা গবেষণায় আরো বেশি যুক্ত হতে হবে, যেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের তেমন কেউ নেই বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে একটি বৈজ্ঞানিক গ্রুপকে প্রমোট করা উচিত, যেমনটা অন্য সেক্টরে করা হচ্ছে। তা না হলে আমাদের আজীবন অন্যের দয়ার ওপরই থেকে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নত দেশগুলো গবেষণার আস্থায় নেবে না। অন্যদিকে কভিডের যতগুলো ট্রায়ালের সুযোগ আমাদের হাতে এসেছিল, সেগুলো আমরা একরকম পায়ে ঠেলেছি, গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সেদিক থেকেও আমাদের অনেকে এখন আর গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে না। তবু এখন আবার যে কয়টি টিকার ট্রায়ালের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, সেগুলোকে লুফে নেওয়া উচিত সামনের প্রয়োজনের দিকে নজর রেখেই।’
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য সূত্র অনুসারে এখন পর্যন্ত মাত্র আটটি টিকার চূড়ান্ত অনুমোদন, ১৩টি টিকার জরুরি বা আগাম স্বল্পমাত্রায় ব্যবহারের অনুমোদন মিলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ অ্যান্ড ফুড অথরিটি থেকে। এর বাইরে এখনো প্রথম পর্বের ট্রায়াল চলছে ৫৪টির, দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়ালে রয়েছে ৪৭টি এবং তৃতীয় পর্বের ট্রায়ালে রয়েছে ৩৫টি টিকা। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু টিকার প্রাথমিক ট্রায়াল প্রাণিদেহে চলছে।