বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার সর্বশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৯ সালের শেষভাগে, খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উদ্যোগে। তখন বাসদসহ ৯টি বামপন্থি দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘বাম গণতান্ত্রিক জোটের’ বিভিন্ন শরিক, অন্য ৯টি বামপন্থি দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত আরেকটি জোট ‘৯ সংগঠন’ এবং চারটি বামদলের সমন্বয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ ছাড়াও কয়েকটি ছোট বামদলের সঙ্গে বৈঠক, মতবিনিময় অথবা টেলিফোন আলোচনা করেছেন উদ্যোক্তারা। পরে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে এই উদ্যোগ থেমে যায়।
বর্তমানে করোনার সংক্রমণ কমে আসায় আবারও ঐক্যের আলোচনা শুরু হয়েছে বামপন্থি দলগুলোর ভেতর। ডা. আবদুল করিমের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (এনডিএফ) এ ঐক্য প্রক্রিয়ায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলাফল সম্পর্কে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ সমকালকে বলেন, ‘একসঙ্গে বসলে সবাই বলেন, ঐক্য চান। কিন্তু আসলে কিছু হয় না। আমরা তো চেয়েছিলাম একমঞ্চে না আসতে পারলেও অন্তত নূ্যনতম বা কমন ইস্যুতে যুগপৎ কিংবা একসঙ্গে আন্দোলন করা যায় কিনা! সেটাতেও আসলে খুব বেশি অগ্রগতি নেই।’
তিনি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে বামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে। এমন বিবেচনা থেকেই তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বামপন্থি রাজনীতির বিশ্নেষকরা বলছেন, দেশের বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে ‘বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার’ কিংবা ‘একমঞ্চে’ আসার লক্ষ্যে বহুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও বৈঠক হলেও গত প্রায় দেড় যুগে সফলতার দেখা মেলেনি খুব একটা।
অবশ্য ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই দেশের প্রধান প্রধান বামদলের সমন্বয়ে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোটের’ আত্মপ্রকাশকে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ‘অগ্রগতি’ বলেই মনে করেন বাম নেতারা। এ ছাড়া কয়েকটি বামদলের এক হয়ে ‘বৃহত্তর দল’ গঠন করাকেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করেন তারা। যেমন, প্রয়াত নির্মল সেনের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, মোশরেফা মিশুর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী ঐক্যফ্রন্ট এবং বাবুল বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০০৮ সালের ৩০-৩১ অক্টোবর কংগ্রেসের মাধ্যমে একীভূত হয়ে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি’ আত্মপ্রকাশ করে।
ভাঙাগড়া জোট ও দলে: ঐক্যের একাধিক উদ্যোগ সফলতা না পেলেও বামপন্থিদের ভাষায় ‘বুর্জোয়া’ শাসকশ্রেণির দল ও জোটের সঙ্গে একমঞ্চে যাওয়া, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, নিজেদের মধ্যকার আদর্শিক মতবিরোধ ইত্যাদি কারণে বাম জোট ও দলগুলো বারবার ভাঙনের মুখে পড়ছে। আবার কয়েকটি দলকে একীভূত করার আলোচনা চললেও খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। যেমন, প্রায় দু’দশক আগে দেশের দুই বৃহত্তম বামপন্থি দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির এক হওয়ার কথা শোনা গেলেও নানা মতবিরোধে সেই প্রচেষ্টা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছিল।
বামপন্থিদের সাম্প্রতিক ইতিহাস বিশ্নেষণে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালে ১১টি বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ‘১১ দল’ ও ১৯৯৯ সালে সাতটি বামপন্থি দলের সমন্বয়ে গঠিত অপর জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এর আত্মপ্রকাশ এবং আন্দোলন-সংগ্রাম দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটলে এবং সেখানে এই দুই জোটর সাতটি বামপন্থি দল যোগ দিলে ‘১১ দল’ এবং ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। এ সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের বিরোধিতা করে ১৪ দলে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে চারটি বামদল- সিপিবি, বাসদ (খালেকুজ্জামান), বাসদ (মাহবুব) এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। পরে অবশ্য ১১ দল ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সক্রিয় করার একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সফলতা আসেনি।
এদিকে, বাসদ (খালেক), বাসদ (মাহবুব) এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল কিছুদিন তৎকালীন সময়ের বামপন্থিদের জোট ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’র কার্যক্রমে যুক্ত হলেও সিপিবি ‘স্বতন্ত্র অবস্থানে’ থেকেই রাজনীতি চালিয়ে যায়। এরপর বাসদ (খালেক) ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’ ছেড়ে সিপিবির সঙ্গে মিলে দ্বিদলীয় জোট ‘সিপিবি-বাসদ মোর্চা’র ব্যানারে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করলে বামদের মধ্যে আরেক দফা মতবিরোধ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অবশ্য পরে সিপিবি ও বাসদসহ বামপন্থি আটটি দল (বর্তমানে ৯টি) মিলে ২০১৮ সালে বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠন করে- যা এখনও সক্রিয় রয়েছে।
গত দেড় দশকে বাম দলগুলোও নানাভাবে ভেঙেছে। এর মধ্যে বড় ধরনের ভাঙনের কবলে পড়েছে বর্তমান ১৪ দলের শরিক রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ‘সুবিধাবাদিতা ও শাসকশ্রেণির লেজুড়বৃত্তির অধঃপতিত রাজনৈতিক ধারায়’ যুক্ত হওয়ার অভিযোগ এনে দলটির পলিটব্যুরোর তৎকালীন সদস্য সাইফুল হক ও খন্দকার আলী আব্বাসের নেতৃত্বে একটি অংশ ২০০৪ সালে দল ছেড়ে প্রথমে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) এবং পরে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আলাদা দল গঠন করে। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও পরে ভাঙনের কবলে পড়ে। ২০১৪ সালে এই দল থেকে পদত্যাগ করে নাসিরুদ্দিন আহমেদ নাসু ও রাজা মিয়ার নেতৃত্বে একটি অংশ গণমুক্তি ইউনিয়ন নামের আরেকটি দলের জন্ম দেন। গণমুক্তি ইউনিয়ন বর্তমানে বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ ৯টি বাম দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘৯ সংগঠন’-এ সক্রিয় রয়েছে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি আরেক দফা ভাঙনের কবলে পড়ে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন ১৪ দলে যুক্ত থাকার মাধ্যমে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি, মতাদর্শগত বিচ্যুতি ও বিলোপবাদী ধারায় অধঃপতিত হওয়ার অভিযোগ এনে দলের পলিটব্যুরোর দুই সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদসহ ছয় কেন্দ্রীয় নেতার উদ্যোগে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) নামের আরও একটি ব্রাকেটবন্দি দলের জন্ম হয়। ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বহিস্কৃত পলিটব্যুরোর সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস এই অংশে যুক্ত হন। ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) বর্তমানে বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক হিসেবে সক্রিয় রয়েছে।
একই সময়ে বাসদের বিভিন্ন অংশের মধ্যেও ভাঙনের কারণে কমপক্ষে তিনটি নতুন দলের সৃষ্টি হয়েছে। নানা ইস্যুতে অন্তর্দ্বন্দ্বের জের ধরে খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাসদ ছেড়ে প্রয়াত মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছিল ‘বাসদ কেন্দ্রীয় পাঠকচক্র ফোরাম’। তবে এই দুই নেতাও পরে এক থাকতে পারেননি। বছর দু’য়েক আগে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে প্রয়াত মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন অংশটি বাসদ (মার্কসবাদী) এবং শুভ্রাংশু চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন অংশটি সাম্যবাদী আন্দোলন নামের পৃথক দুটি দল গড়ে তোলেন। বর্তমানে বাসদ (মার্কসবাদী) বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং সাম্যবাদী আন্দোলন ‘৯ সংগঠন’-এর শরিক হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রেজাউর রশীদ খানের নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র একটি অংশ বাসদ (মাহবুব) থেকে বেরিয়ে বাসদ (রেজাউর) নামের আরেকটি দল প্রতিষ্ঠা করে ১৪ দলে যুক্ত হয়েছে।
নেতারা যা বললেন: বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ভাঙনটাই কেবল বামপন্থিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র চেহারা নয়। মূল কথা হচ্ছে, ভাঙনের মধ্যেও একটা সঠিক নীতি-আদর্শ নিয়ে দলের সাংগঠনিক শক্তির বিকাশ এবং ঐক্যবদ্ধ ক্রমপ্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সেটা বাম আদর্শকে আরও শক্তিশালীও করছে। বামপন্থিদের দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সহসাই পরিলক্ষিত হবে বলে আশা করা যায়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বামপন্থি কোনো কোনো দলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভাঙন বা বিভক্তি দেখা যাচ্ছে- এটা সত্য। তবে সেটা বামপন্থিদের প্রধান ধারা নয়। আর বাম প্রগতিশীল দলগুলো এখন নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এটাও মনে করছে, সরকারের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন ও শাসকশ্রেণির সামগ্রিক ব্যর্থতায় সৃষ্ট পরিস্থিতির নিরসন করতে হলে বামপন্থিদেরই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে হবে। এ লক্ষ্যে নূ্যনতম ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়িয়ে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি আছে এবং আরও অগ্রগতি আসবে বলে আশা করা যায়।