কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই মৌলিক নীতির প্রশ্নেই ইইউ জোটের সাথে পোল্যান্ডের বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। পোল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত বৃহস্পতিবার এক রায়ে বলেছে- ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল চুক্তির কিছু ধারার সাথে পোলিশ আইনের কোনও সামঞ্জস্য নেই।
এই রায়ের মাধ্যমে পোল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালত পক্ষান্তরে ইউরোপীয় আইন এবং ইউরোপীয় আদালতের শ্রেষ্ঠত্বের বিধান প্রত্যাখ্যান করল।
মানবাধিকার বা সমকামী অধিকারের মত কিছু ইস্যুতে পোল্যান্ডের সরকারের সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রাসেলসের টানাপোড়েন চলছিল। সেই বিরোধে এখন নতুন মাত্রা যোগ হল।
যেসব মৌলিক নীতি ইউরোপীয় জোটের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়, তাকে পোলিশ প্রধানমন্ত্রী মোরাভিয়েস্কির সরকার যেভাবে চ্যালেঞ্জ করছে তা নজিরবিহীন।
আর এর ফলে, উদ্বেগ বাড়ছে যে ব্রিটেনের মত পোল্যান্ডও কি ইউরোপীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরছে? ইতিমধ্যেই পোল্যান্ডে ব্রেক্সিটের মত ‘পোলেক্সিট‘ শব্দটি উচ্চারিত হতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় জোটের দেশগুলোতে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ শুরু হয়েছে। পোলিশ সাংবিধানিক আদালতের রায়ের পর ফ্রান্স বলছে ইইউ জোট থেকে পোল্যান্ডের প্রস্থান এখন “সত্যিকারের একটি ঝুঁকি।”
শুক্রবার ফরাসি এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতিতে পোলিশ সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের প্রধান একটি শর্ত হচ্ছে, “অভিন্ন কিছু মূল্যবোধ এবং রীতিনীতিকে শর্তহীনভাবে এবং অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে,” এবং এটি “শুধু নৈতিক অঙ্গীকার নয়, এটি একটি আইনি অঙ্গীকারও বটে।”
ইউরোপীয় কমিশন হুঁশিয়ার করেছে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে তারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভর ডেন লেইন বলেছেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পোলিশ নাগরিকদের যেসব সুযোগ সুবিধা দিয়েছে তা রক্ষা করা আমাদের প্রধান একটি অগ্রাধিকার।”
‘পোলিশ সংস্কারের সুরক্ষা’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিংহাম সেন্টার ফর দি রুল অব ল-এর গবেষক প্যাট্রিক ওয়াকোভিয়েচ বলেন, “সত্যিকার অর্থে, পোলিশ সাংবিধানিক আদালতের রায় আইনের জগতে একটি ‘পোলেক্সিট‘-এর সূচনা। কারণ পোলিশ এবং ইউরোপীয় আদালতের মধ্যে সহযোগিতা এর ফলে আরো জটিল এবং কঠিন হবে, বিশেষ করে কোনও রায় দিয়ে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে।”
ওয়াকোভিয়েচ মনে করেন পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ইউরোপীয় আদালতের রায় আটকাতে এই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছেন। গত প্রায় ছয় বছর ধরে পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগে ব্যাপক যে পরিবর্তন এনেছে ইউরোপীয় আদালত তা পছন্দ করেনি।
সরকারে উঁচু আদালতে সরকারের বিতর্কিত কিছু নিয়োগের কড়া সমালোচনা করেছে ইউরোপীয় আদালত।
‘ফেক নিউজ’
ইউরোপীয় কমিশন বলছে যেসব পরিবর্তন পোল্যান্ডে সম্প্রতি আনা হয়েছে তাতে সেদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং আদালতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির (পিআইএস) সংস্কার কর্মসূচির প্রথম টার্গেট ছিল সাংবিধানিক আদালত। ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের মতে, পোলিশ এই সাংবিধানিক আদালতে এমন সব বিচারকদের এখন বসানো হয়েছে যারা হয় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক না হয় দলের প্রতি সহানুভূতিশীল। এমনকি একজন বিচারকের নিয়োগও ছিল অবৈধ।
প্রধানমন্ত্রী মোরাভিয়েস্কি এবং পিআইএস দলের ক্ষমতাধর চেয়ারম্যান এবং উপ প্রধানমন্ত্রী জারোস্ল কাজনিস্কি অবশ্য বলেন, পোল্যান্ডকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার কোনও উদ্দেশ্যই তাদের নেই।
তিনি বলেন, ইইউ পন্থী ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে বিরোধী দলগুলো এই ‘ফেক নিউজ’ ছড়াচ্ছে।
তবে পোল্যান্ডে এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে যারা মনে করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কারণে তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
পোলিশ সরকার অবশ্য স্বীকার করেন যে ইইউ-এর সদস্যপদের কারণে তার দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ হয়েছে যা দেশকে আমূল বদলে দিয়েছে। তাছাড়া, ইউরোপের অভিন্ন বাজারকেও অসামান্য সুযোগ হিসেবে তারা দেখে।
সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে বিরোধীরা। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টুস্ক, যিনি পোল্যান্ডের প্রধান বিরোধী সিভিক কোয়ালিশনের প্রধান, সাংবিধানিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন।
“ইউরোপ থেকে পোল্যান্ডকে বের করে আনার যে পরিকল্পনা জারোস্ল কেজনিস্কি করেছেন তা বাস্তবায়নের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। আমরা যদি এখন চুপ করে থাকি তাহলে কেউ তাকে ঠেকাতে পারবে না,” টুইটারে এক ভিডিও পোস্টে বলেন টুস্ক।
‘ব্রাসলেস স্বৈরতন্ত্র”
পোল্যান্ডের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান মুখে বলছেন যে তারা কোনও ‘পোলেক্সিট‘ চান না, কিন্তু কেজনিস্কির দুই ঘনিষ্ঠ রাজনীতিক -মারেক সাসকি এবং রিজার্ভ টেরলেসকি প্রকাশ্যে ইইউ বিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছেন।
গতমাসে সাসকি ইউরোপীয় কমিশনকে “দখলদারি” বলে বর্ণনা করে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেন।
অন্যদিকে টেরলেসকি, যিনি ক্ষমতাসীন পিআিইএস এর সংসদীয় দলের প্রধান, বলেন ব্রিটেন দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে জোট থেকে বের হয়ে গিয়ে “ব্রাসলেসের স্বৈরতন্ত্র এবং আমলাতন্ত্রকে” পরাজিত করা যায়। তিনি বলেন, পোল্যান্ড ইইউতে থাকতে চায় তবে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে “চরম সমাধানের” পথে নিতে হবে।
অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, ইইউ বাজেট থেকে পোল্যান্ড যত টাকা এখন পাচ্ছে তার চেয়ে যখন তাদেরকে বেশি দিতে হবে তখন দেশটি জোট থেকে বেরিয়ে যাবে এবং তারই পায়তারা এখন শুরু হয়েছে।
আবার এটাও হতে পারে যে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে দিয়ে ব্রাসেলসের কাছে থেকে যত সম্ভব সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে পোলিশ সরকার।
কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক উত্তরণের জন্য পোল্যান্ডের সরকার ইইউ-এর কাছ যে ৫৭ বিলিয়ন ইউরো চেয়েছে তা এখনও অনুমোদন করেনি ইউরোপীয় কমিশন। এ নিয়ে দেন-দরবার চলছে। অনেকে মনে করছেন অনুমোদন পেতে ইইউ কমিশনের ওপর চাপ তৈরির উদ্দেশ্যে সাংবিধানিক আদালতের এই রায় টাকা-পয়সা নিয়ে বোঝাপড়া হলে ওই রায় নিয়েও মীমাংসা হতে পারে কারণ সরকার এখনও ওই রায় গেজেট আকারে প্রকাশ করেনি।
‘ব্রিটেনের মত গর্বিত’
সরকার-পন্থী পোলিশ সাপ্তাহিক সেচির প্রধান সম্পাদক জসেফ কারনস্কি বিবিসিকে বলেন পোলেস্কিট ‘কল্পনাতীত এবং অবাস্তব’, যদিও তিনি স্বীকার করে বিষয়টি নিয়ে পোল্যান্ডে কথা-বার্তা শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ব্রিটিশদের মত পোলিশরাও একটি ‘স্বাধীনচেতা গর্বিত’ জাতি কিন্তু পোল্যান্ড ব্রিটেনের চেয়ে “অনেক দুর্বল।”
“ক্ষমতাসীন দল পিআইএসের মূলধারার নেতা-কর্মীরা মনে করেন পোল্যান্ডের উচিৎ ইইউ জোট যেন পোল্যান্ডের সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দেয় এবং জোটের মধ্যে যেন তাদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীর না হয়,” বলেন কারনস্কি।
তিনিও নিজেও মনে করেন ইউরোপীয় কমিশনের আচরণ অনেকটাই আগ্রাসী এবং ইইউ বাড়াবাড়ি করে। “পোলিশ সরকারি নেতারা মনে করেন ব্রাসলেস তাদের প্রতারণা করছে। বৃহস্পতিবার পোলিশ সাংবিধানিক আদালতে যে রায় হয়েছে তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাড়াবাড়ি আচরণের দায় রয়েছে।”
তার মতে, ব্রাসেলস পোল্যান্ডের জন্য একটি ফাঁদ তৈরি করেছে। “হতে পারে পোল্যান্ডকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের ওপর সেই চাপ তৈরি করা হচ্ছে।”
কারনস্কি বলেন, পোল্যান্ডকে বলা হচ্ছে হয় ব্রাসেলসের “অনুগত উপনিবেশ” হিসেবে থাকতে হবে আর নাহলে জোট থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। “যদি সরকারকে কখনো বলতে হয় যে আমরা ইইউ ছেড়ে যেতে চাই, সরকার পড়ে যাবে। সুতরাং ব্রাসেলস একটি ফাঁদ পেতেছে।”