গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামের যুবক চাষী নূর আলম গত তিন বছরে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যায়ে ৩০ শতক জমিতে ড্রাগন বাগান গড়ে তোলেন। চতুর্থ বছরেই প্রথম ড্রাগন ফল বিক্রি করে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করেন। চলতি তথা পঞ্চম বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার ড্রাগন বিক্রি করেছেন। বাগানে ফুল ও ফল থাকা সাপেক্ষে আরও এক লাখ টাকা আয় করার আশা পুষছেন। তিনি তার আশার থেকেও বেশি লাভবান হয়েছেন।
ইতোমধ্যে প্রায় তিন একর জমিতে সাতজন উদ্যোক্তাকে ড্রাগন চাষের পরামর্শ দিয়ে তাদেরও বাগান তৈরীতে সহযোগিতা করেছেন। তিনজন উদ্যোক্তাকে এক একর জমিতে ড্রাগন বাগান করে দিয়েছেন। আরও দুই একর জমিতে চারজন কৃষকের কাছ থেকে ড্রাগন চাষের অর্ডার পেয়েছেন। কার্ত্তিক মাস থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত ড্রাগন চাষের উপযুক্ত সময় বলে জানান ওই ড্রাগন চাষী। এ সময়ে ড্রাগনের বাগান তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন।
চাষী নূর আলম জানান, গত আট বছর আগে বান্দরবান জেলার একটি ড্রাগন বাগানে তিন বছর চাকুরী করেন। সেখানে ড্রাগনের চাষবাস ও নানা প্রক্রিয়া দেখে নিজে ড্রাগন বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হন। সেখান থেকে পাঁচ বছর আগে ড্রাগনের ২০টি চারা নিয়ে আসেন। কিছু জমিতে ড্রাগনের চারা রোপণ করে পরিচর্যা করেন। দ্বিতীয় বছর থেকে ওইসব চারা থেকে অল্পকিছু ফলন পেতে শুরু করেন। ওইসব চারা থেকে বাড়িয়ে সবশেষ ত্রিশ শতক জমি ড্রাগন চাষের আওতায় আনেন।
তিনি জানান, জমি তৈরী ও ড্রাগনের চারা রোপনে তাঁর প্রথম বছর ব্যায় হয় ১লাখ ৮০ হাজার টাকা। পরে প্রত্যেক বছর পরিচর্যা বাবদ ৩০ হাজার টাকা ব্যায় হচ্ছে।
গাছে পাতা না থাকায় কোনো কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। ছত্রাকের আক্রমণ হয়। তাই মাঝে মধ্যে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এ চাষে তিনি কোনো কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নেননি। নিজের দেখা এবং অভিজ্ঞতা থেকে সফলতা পেয়েছেন।
স্থানীয় ফল দোকানীদের কাছে তিনি ড্রাগন ফল বিক্রি করেন। ঢাকার কারওয়ান বাজার ফলের আড়তে একবার আড়াই’শ কেজি ড্রাগন বিক্রি করেছিলেন। এলাকার চাহিদা পূরণ করতে না পারায় ঢাকার আড়তে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। শুরু থেকেই তিনি ৩’শ টাকা কেজি দরে ড্রাগন ফল বিক্রি করছেন। একই দরে তার বাগান থেকেই পাইকার ও ক্রেতারা ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পাইকারের চাইতে এলাকার মানুষের কাছে তার বিক্রি বেশি। একেকজন ১০ থেকে ৪০ কেজি কিনে নিয়ে যান। ক্রেতার মাধ্যমে তার বাগানের প্রচার যেমন বাড়ছে তেমনি চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদার কারণে অনেককে তিনি ফল দিতে পারছেন না। ড্রাগন চাষে তিনি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন।
তিনি জানান, গত বছর তার বাগানে পূর্ণ মাত্রায় ফলন আসে। ওই বছর ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেন। চলতি বছর ইতোমধ্যে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার ফল বিক্রি করেছেন। বাগানে যে পরিমাণ ফুল ও ফল রয়েছে তাতে আরও এক লাখ টাকার ফল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা রাখছেন।
আনুমাণিক ৩৫ শতক জমিতে একবার ড্রাগন চাষ করা হলে প্রতি বছর ৩০ হাজার টাকা পরিচর্যা বাবদ খরচ হয়। যতœ করলে ড্রাগন চারার কোনো মৃত্যু হয় না।
এলাকার ক্রেতা তৌহিদ জানান, তিনিও গত ৬ মাস যাবত তার কাছ থেকে ড্রাগন ফল কিনছেন। নিজে খেয়েছেন এবং আত্মীয় স্বজনকে বিতরণ করেছেন। বাইরে থেকে দেখতে হলুদ, গোলাপী ও অফ হোয়াইট বর্ণের হলেও ড্রাগনের ভেতরটা গাঢ় গোলাপী হয়ে থাকে। বড় এবং পরিপক্ক ড্রাগন খেতে বেশ সুস্বাদু।
অপর ক্রেতা ইউসুফ আলী জানান, বিদেশী এ ফল খেতে কেমন তা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি। পরে বাগান থেকে আপ্যায়ন করায় স্বাদ দেখে কিনতে শুরু করেন। এখনও তার পরিবার এবং স্বজনদের জন্য ড্রাগন ফল কিনে নিয়ে যান।
একই এলাকার আমীর হামজা জানান, তিনি ড্রাগন চাষী নূর আলমকে এক বিঘার কিছু বেশি জমি ড্রাগন চাষের জন্য চুক্তি দিয়েছেন। অল্প পরিশ্রমে অধিক লাভজনক ড্রাগন চাষে তার মতো অনেকই উৎসাহিত হচ্ছে।
অপর উদ্যোক্তা কামাল হোসেন জানান, ভেতরটা দেখতে গোলাপী এবং সুস্বাদু এ ফলের প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ রয়েছে। একটি বাগান থেকে ফল নিতে দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন আসছে, অর্ডার করছে। উৎপাদন ও পরিচর্যা খরচ খুব বেশি লাগে না। মানুষের ব্যাপক চাহিদা দেখে তিনিও উৎসাহিত হয়ে ৩৫ শতক জমি ড্রাগন চাষের জন্য প্রস্তুত করছেন।
শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তার ফল ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হোসেন জানান, ড্রাগন ফলের অনেক চাহিদা। প্রতিদিন তিনি ৩০ থেকে ৪০ কেজি ড্রাগন ফল বিক্রি করতে পারেন। তাঁর মতো আরও অনেক ফল ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা এরকমভাবেই কমবেশি বিক্রি করেন। এ ফলটি খোলামেলা স্থানে অন্যান্য ফলের চেয়েও বেশিদিন সুরক্ষিত থাকে।
গাজীপুর জেল্ াকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মোর্ত্তুজ আলী জানান, ড্রাগন, বেদেনা ম্যাংগো, কপি কাজু বাদাম ইত্যাদিন নতুন ফসলের ব্যাপারে কৃষি বিজ্ঞানীদের সাথে কথা হচ্ছে। রাতে কৃত্রিম আলোতে অসময়ে ড্রাগন ফুল ফুটিয়ে ফলনের বিষয়টিও আমাদের দক্ষতায় এসেছে। ইন্টারনেট থেকেও আমরা নতুন এসব ফসলের ব্যাপারে জ্ঞান নিয়ে আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছি। তাছাড়া ইতোমধ্যে আমাদের কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।