গণপরিবহণে নারীদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের তথ্য পুরনো। এছাড়া যৌনহয়রানির খবরও নতুন নয়। কোনো কোনো গণপরিবহণে দলবেঁধে ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী নারীকে হত্যাও করা হয়। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন নিষ্ঠুরতা। চলন্ত বাস থেকে শিশুকে ছুড়ে মারা ও যাত্রীকে লাথিকে বাস থেকে ফেলে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা শুরু হয়েছে গণপরিবহণগুলোয়।
এসব ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, এ ধরনের নিষ্ঠুরতা বন্ধ করার জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এমন বর্বরতা দিনে দিনে বেড়ে চলবে বলেও তারা মনে করছেন।
সম্প্রতি ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি নিষ্ঠুরতা ঘটেছে।
ঘটনা-১: রাজধানীতে প্রগতি সরণিতে রাইদা পরিবহন নামে একটি বাস থেকে ১০ বছরের কন্যাশিশু মরিয়মকে ফেলে হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করেছেন। ১৩ নভেম্বর বাসের চালক রাজু মিয়া ও হেলপার ইমরান হোসেনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
এই বিষয়ে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেছেন বাসচালক ও হেলপার। তারা জানিয়েছেন, গত ৯ নভেম্বর চালক রাজু মিয়া ও হেলপার ইমরান হোসেন প্রতিদিনের মতোই রাইদা পরিবহনের একটি বাস নিয়ে পোস্তগোলা থেকে দিয়াবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। বাসটি যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে পৌঁছালে মরিয়ম বাস যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাইতে গাড়িতে ওঠে। বাসটি চলতে শুরু করার পরপরই হেলপার ইমরান মেয়েটিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে ড্রাইভার রাজুকে বাসের গতি কমাতে বলেন। শিশুটিকে বাসের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। এ সময় বাসের চালক রাজু কিছুদূর না যেতেই আবার থামতে বলায় বিরক্ত হয়ে গতি হালকা কমিয়ে মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি নামতে বলেন। তবে মরিয়ম নামার সময় চালক রাজু হঠাৎ করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলে সে বাসের দরজা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে প্রাণ হারায়।
ঘটনা-২: চট্টগ্রাম লালখান বাজার যাওয়ার জন্য ওয়াসার মোড় থেকে ১০ নম্বর বাসে ওঠেন হামিদ নামের এক যাত্রী। বাসে উঠে চালকের সহকারী মো. আশরাফকে পাঁচ টাকা ভাড়া দিলে তিনি ১০ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে হামিদের সঙ্গে আশরাফের বাগবিতণ্ডা হয়। এ সময় হামিদকে লালখান বাজার না নামিয়ে টাইগারপাস নিয়ে যান চালক-সহকারী। সেখানে নিয়ে লাথি মেরে তাকে সড়কে ফেলে দেন আশরাফ। অভিযোগ পেয়ে বাসচালক ও তার সহকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এমন নিষ্ঠুরতা চিত্র প্রায় দেখা যায় গণপরিবহন খাতে। প্রতিদিনই পরিবহণ শ্রমিকদের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হচ্ছেন কেউ না কেউ। গণপরিবহন শ্রমিকদের নিষ্ঠুরতা কমার বদলে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েও চালক-শ্রমিকরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। প্রশাসনের নাকের ডগায় ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও অনভিজ্ঞ চালকদের দিয়ে বাস চালানো হলেও চালক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তেমন দেখা যায় না।
এই বিষয়ে কয়েকজন যাত্রী ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘বাসের বেপরোয়া চলাচল নিয়ে আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। পরিবহন খাতের সংগঠনগুলোর ক্ষমতার দাপটের কাছে আমরা অসহায়।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘পরিবহণ খাতের সর্ব অঙ্গে ব্যথা, মলম দেবো কোথায়? পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা নানান অজুহাতে ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে নিজেদের দাবি আদায় করে নিচ্ছে। আসলে পরিবহণ নৈরাজ্যের কাছে আমরা অসহায়। সরকার পরিবণ মালিক-শ্রমিকদের ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। এর ফলে তারা দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সামনে হয়তো পরিবহণ মালিক-শ্রমিদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হবে ছাত্র-জনতা। ওই সময় আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নেবো।’
কথা হয় কয়েকজনের গণপরিহন শ্রমিকের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘কিছু কিছু যাত্রী যেমন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, তেমনি আমরাও মাঝে মাঝে এসব সহ্য না করতে পারে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করি।’
পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নিষ্ঠুরতা বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমি ‘২৮ বছর ধরে নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু দেশের সড়ক এখনো নিরাপদ হয়নি। সরকার সবসময় পরিহণখাতকে প্রশ্রয় দিয়েই যাচ্ছে। পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা মনে করেন, তারা যতই অপরাধ করুক, কিছু হবে না। তাই তারা চাইলে যেকোনো সময় সারাদেশে গণপরিহন বন্ধ করে দিতে পারেন। তাদের কাছে সবাই জিম্মি। তাই অপরাধ করেই যাচ্ছেন। সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সড়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।’
পরিবহন মালিক শ্রমিকদের নিষ্ঠুরতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান অনলাইনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নেই। এমন কিছু ঘটে থাকলে তা খুব দুঃখজনক। কোন পরিপ্রেক্ষিতে এমন ঘটনা ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দোষী প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করছি।’