প্রতিউত্তরে হেল্পার বললেন, বিহঙ্গ বাসে কোনো স্টুডেন্ট এবং হাফ পাস কাটা হয়না। তাই সম্পূর্ণ ভাড়াই দিতে হবে। তারপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেওয়ার পর বাসের হেল্পারের উত্তর, ‘তাতে কী হয়েছে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে আয়মান রিফা। উত্তরার নিজ বাসায় মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে গেলেও অধিকাংশ সময়েই আসা-যাওয়া করেন লোকাল বাসেই। হাফ ভাড়া নিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের বাস হেল্পারের সঙ্গে নিয়মিত তর্কে জড়ানোর চিত্র নিয়মিতই চোখে পড়ে এই শিক্ষার্থীর। তবে সমাধানের কেউ না থাকায় নীরব ভূমিকা অবলম্বন করতে হয় বলে দাবি তার। শুধু সানাউল্লাহ সাজিদ কিংবা রিফা না। নিজ বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে অর্ধেক ভাড়া নিয়ে বাস হেল্পার কিংবা টিকিট চেকারের সঙ্গে রীতিমতো একধরনের যুদ্ধই করতে হয় শত শত শিক্ষার্থীর। মাঝে মধ্যেই তর্কের পর্যায় রূপ নেয় শিক্ষার্থীদের মারধর কিংবা হেনস্তা করা পর্যন্ত।
রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে অর্ধেক ভাড়ার নিয়ম থাকলেও, তা অমান্য করাটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ গাড়ির গায়ে লেখা থাকে ‘হাফ পাস নাই’। কথিত সিটিং সার্ভিসের অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় পূর্ণভাড়া। অনেক সময় হাফভাড়া দিতে গেলে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়া হয় বাস থেকে। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে হাফ ভাড়া যেন একপ্রকার বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশি দেশ ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম, মাল্টা, মরিশাসসহ আফ্রিকা-ইউরোপের অনেক দেশেই চালু রয়েছে শিক্ষার্থীবান্ধব এই প্রথা। তবে সমস্যা শুধু বাংলাদেশে। শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাফ ভাড়ার রেওয়াজ বাংলাদেশেও ছিল; তবে এর প্রয়োগ দিন দিন কমছে। বিষয়টি কার্যকর করতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চমহল থেকে নিয়ম বেধে দেয়া হলেও খোদ তাদের নিয়ন্ত্রিত বিআরটিসি বাসেই লেখা হচ্ছে ‘হাফ পাস নাই।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা আয় রোজগার করেন না। পরিবারের টাকা, টিউশনি, পার্টটাইম ইত্যাদি উপায়ে টাকা ম্যানেজ করে চলেন তারা। মূলত সেই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার প্রচলন ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, দিন দিন সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাফ ভাড়া দিতে গেলে কখনো শিক্ষার্থীদের অপমান-অপদস্ত হতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ২৪৬টি রুটে প্রায় ৮ হাজার বাস চলাচল করে। অথচ এর মধ্যে হাতে গোনা ১০-১২টি রুটে হাফ ভাড়ার প্রচলন ছিলো। সম্প্রতি বাসের বাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পর এই সংখ্যা ২-৩ এ নেমে এসেছে। বেশিরভাগ বাসের দরজার ওপরে বা পাশেই লেখা হচ্ছে হাফ পাস বা শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে হাফ ভাড়ার তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৬৪ সালে বিআরটিসি চারটি বাস দিয়ে সরকারিভাবে গণপরিবহন সেবা দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে সরকারের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেওয়া হতো। কিন্তু এটা ছিল সম্পূর্ণ সরকারি সেবা। পরবর্তীতে যখন সরকারি বাসের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বাস গণপরিবহনের সেবা দেওয়া শুরু করে। তখন সরকারি বাসের নিয়মে বেসরকারি বাসেও ছাত্রদের হাফ ভাড়া নেওয়া হত। কিন্তু এ বিষয়ে যেহেতু কোনো লিখিত নিয়ম নাই। এটা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, যেটা পরবর্তীতে চলে আসছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইয়াজুল আজাদ রুদ্র বলেন, সদরঘাটগামী বাসগুলোতে এখন আর হাফ পাস নেই। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আগেই বাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দেবার পরও হাফ ভাড়া রাখা হতো না। উলটো আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত বাসের স্টাফরা। নতুন করে বাস ভাড়া বৃদ্ধির পর বিষয়টি লাগামহীন হয়ে গেছে। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই। নারী শিক্ষার্থীদেও অভিযোগ, লোকাল বাসে উঠে তাদেরও হাফ ভাড়া নিয়ে তর্ক করতে হয়। এটি দৃষ্টিকটু ও চরম ভোগান্তির বিষয়। তেলের দাম ও ভাড়া বাড়ানোর সাথে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার কোন সম্পর্ক নেই। এটি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। আমরা আশাবাদী প্রশাসন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল বলেন, বাস কাউন্টারের পাশের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিতের বিষয়ে কথা বলেছি। ফাঁড়ির ইনচার্জ সবগুলো বাসের ব্যবস্থাপককে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে বলবে। শিক্ষার্থীরা ঢাকার ভেতরে কোন জায়গায় গেলে তাদের কাছে থেকে হাফ ভাড়া নিবে। তিনি আরও বলেন, তবে অনেক সময় শিক্ষার্থী না হয়েও হাফ ভাড়ার সুযোগ নিতে চায়। সেক্ষেত্রে কখনো আইডি কার্ড দেখানোর প্রয়োজন হলে শিক্ষার্থীরা তা দেখালেই ভালো হবে। যদি হেল্পার হাফ ভাড়া না নেয় সেক্ষেত্রে ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়ে বিষয়টি পুলিশ ফাঁড়ি অথবা প্রশাসনকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, এখন বেসরকারি বাসে হাফ ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। আগে নেওয়া হতো। কারণ আগে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম ছিল, এখন তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বাস থেকে হাফ ভাড়া নিতে গেলে মালিকদেরও ক্ষতি হয়। হাফ ভাড়া শুধু সরকারি বাসে (বিআরটিসিতে) নেওয়ার সুযোগ আছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাস ড্রাইভার জানান, শিক্ষার্থীদের থেকে আমাদের হাফ ভাড়া নিতে কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এখন আমাদের মালিকরা দিন শেষে বেশি টাকা চায়। আগে সারাদিনে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিতে হতো। এখন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেওয়া লাগে। এখন আবার শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেশি। হাফ ভাড়া নিলে আমাদের ট্রিপের টাকা উঠে না। মালিকপক্ষ থেকে চাহিদা কম থাকলে আমাদের হাফ ভাড়া নিতে সমস্যা নেই।