সু চির বিরুদ্ধে দুই মামলায় করোনা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ এবং অভ্যুত্থানকারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সু চিকে কেবল এবারের সামরিক অভ্যুত্থান থেকেই নয়, বরং এর আগেও ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গৃহবন্দি করে রাখে। পরে সু চি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হন।
জান্তার আমলে ৭৬ বছর বয়সী সু চির এটি প্রথম সাজা। গত বছরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে সামরিক জান্তা মিয়ানমারে ক্ষমতা দখল করে। সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডি ওই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করে। যদিও নিরপেক্ষ নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা ওই নির্বাচনে বড় কোনো অনিয়ম পাননি। সু চির বিরুদ্ধে এ রায়ের প্রতিবাদে মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান শহর মান্দালয় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনের মতো সেখানেও বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্লোগান ও গান গেয়ে প্রতিবাদ জানায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববাসীও এ রায়কে প্রহসন বলে নিন্দা জানিয়েছে।
সু চির বিরুদ্ধে মামলাগুলো বস্তুত পরিকল্পিতভাবে তার ইমেজ হরণের জন্য যেমন করা হয়েছে, তেমনি এর সঙ্গে পরবর্তী নির্বাচনেরও সম্পর্ক রয়েছে। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গসহ তার বিরুদ্ধে আরও ৯টি মামলা করেছে সামরিক জান্তা। এসব মামলায় সু চি দোষী সাব্যস্ত হলে তার ১০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে। সামরিক বাহিনী তাকে গোপন স্থানে নিয়ে গেছে এবং রাষ্ট্রীয় টিভির খবর অনুসারে, সেখানেই তার সাজা দেওয়া হতে পারে।
কিন্তু যে সু চি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন এবং যাকে গণতন্ত্রকন্যা বলে অভিহিত করা হয়; সেই সু চি ২০১০ সালে মুক্তিলাভের পর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে কাজ করেন। এমনকি তখনও তিনি সামরিক বাহিনীর প্রতি অনুগত ছিলেন, যখন ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সামরিক শক্তি গণহত্যা চালায়। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের চেষ্টায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও সু চি ছিলেন নীরব। এ কারণে তিনি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচিত হন। এমনকি সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। কার্যত সু চি ২০১৫ সালে বিপুল ভোটে জিতে মিয়ানমারের ক্ষমতায় এসে তার ভোল পাল্টে ফেলেন। ‘সন্ত্রাস দমন’-এর নামে চার বছর আগে রাখাইনে সেনা অভিযানে গণহত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, নির্যাতন ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষকে দেশ ছাড়তে দেখেও ‘নিষ্ফ্ক্রিয়’ ভূমিকায় ছিলেন সু চি। ওই সময় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন সু চি ছিলেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এবং জনপ্রিয় নেত্রী। তারপরও রোহিঙ্গা নিপীড়নে সু চির চুপ থাকার ঘটনায় বহির্বিশ্বে তার সুনাম যেমন নষ্ট হয়, তেমনি তার উল্লেখযোগ্য বিদেশি সম্মাননাও কেড়ে নেওয়া হয়। এখন অবশ্য মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী ঐক্য সরকার বা ছায়া সরকার, যার অন্যতম প্রধান অংশীদার সু চির এনএলডি, সেই ঐক্য সরকার এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান পাল্টিয়েছে। এবং প্রায় সব সংখ্যালঘুকে নিয়েই তারা আন্দোলন করে যাচ্ছে। সেই ঐক্য সরকার বলেছে, সু চির রায়ের দিনটি আসলে মিয়ানমারে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহির জন্য একটি লজ্জাজনক দিন। এর মাধ্যমে সেখানে সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে স্থায়ী করার আয়োজন চলছে। ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই সে দেশে এ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। সামরিক বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর বারবার হামলা চালিয়েছে। তারা প্রায় এক হাজার ৩০০ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। সেখানে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদকারীদের ওপর জান্তা যেভাবে চড়াও হয়েছে, তাতে অস্ত্রের ব্যবহারও বাড়ছে। সেদিক থেকে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মিয়ানমার বেসামরিক যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। এর মধ্যে সোমবার সু চির বিরুদ্ধে ঘোষিত এ রায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলবে।
সু চির অন্যান্য মামলার সিদ্ধান্ত আগামী সপ্তাহে হতে পারে। অং সান সু চির এ সাজার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট, মিয়ানমারে গণতন্ত্র আরও সুদূরপরাহত। সামরিক বাহিনী সেখানে তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সেখানে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং মিয়ানমার যেভাবে দেশে ও দেশের বাইরে থেকে চাপে পড়ছে; সেটিই বোধ হয় আশার আলো।