ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে যেমন মিল আছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও তাই। তবে গত কয়েক বছরে শিক্ষায় ভিয়েতনাম যে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের মতো একটা অবস্থানে থেকে যাত্রা শুরু করে তারা কেন এবং কীভাবে এতটা এগিয়ে গেল, সেটাই এই লেখার উপজীব্য।
আমরা স্বাধীন হই ১৯৭১ সালে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সমর্থিত উত্তর ভিয়েতনাম তখন পুঁজিবাদী বিশ্ব সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামকে পরাজিত করে দুই ভিয়েতনামকে এক করে নতুন ভিয়েতনামের যাত্রা শুরু করে ১৯৭৬ সালে। সেই হিসাবে বয়সের দিক থেকে বাংলাদেশ একটু এগিয়ে। আমাদের জাতির পিতার যেমন শিক্ষার প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছিল; তাদের প্রধান নেতা হো চি মিনের ক্ষেত্রেও তাই। বঙ্গবন্ধু যেমন শিক্ষাকে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন; রাষ্ট্র যেন শিক্ষার সব দায়িত্ব নেয়– সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছেন; শিক্ষার পেছনে ব্যয়িত অর্থকে যেমন সর্বোত্তম বিনিয়োগ বলে আখ্যায়িত করেছেন; হো চি মিনও তাই। শিক্ষা সম্পর্কিত চায়নিজ প্রবাদবাক্য অনুকরণে তিনি বলতেন, ‘আমরা যদি ১০ বছরের লাভের কথা চিন্তা করি তাহলে গাছ লাগাতে হবে (অর্থাৎ ভূমি কর্ষণ করতে হবে); আর আমরা যদি একশ বছরের লাভের চিন্তা করি তাহলে মানব কর্ষণ করতে হবে।’ এ কারণেই তাদের মাথাপিছু আয় যদিও পাশের দেশ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে কম (ভিয়েতনামের ৩৭৬০; বাংলাদেশের ২৪৬৯ ডলার) হলেও শিক্ষায় তারা এগিয়ে।
বলা হয়, ভিয়েতনামের স্কুলগুলো হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্কুল। পঠন, গণিত ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন হয়, সেখানে তারা অনেক এগিয়ে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ভিয়েতনাম এসব ক্ষেত্রে তো মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের চেয়ে ভালো বটেই, এমনকি তার চেয়ে ছয় গুণ ধনী ব্রিটেন ও কানাডার চেয়েও ভালো। এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন পরিচালিত এডুকেশন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ মাধ্যমিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ কিংবা মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিলের চেয়ে ভালো করলেও ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
আমরা যদি শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি তাহলে ভিয়েতনামের অবস্থা খুবই ভালো। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ২০২২ সালে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা দেখাচ্ছে, ১৯৬০-এর দশক থেকে হিসাব করলে ৮৭টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে ৫৬টি দেশেই শিক্ষার গুণগত মান কমেছে। শিক্ষার গুণগত মান পড়ে যাওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও নাইজেরিয়া রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে ভালো; সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হচ্ছে নাইজেরিয়ার। আর যেসব দেশে শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে পেরু, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম। এর ভেতর ভিয়েতনামের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে আরও পিছিয়ে। ২০২০ সালে স্টকহোম স্কুল অব ইকোনমিক্সের অভিজিত সিং ইথিওপিয়া, ভারত, পেরু ও ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি গবেষণা করেন। সেখানে তিনি দেখেন, ৫ থেকে ৮ বছর বয়সী ভিয়েতনামি শিক্ষার্থীরা সবার চেয়ে এগিয়ে। ভিয়েতনামি ওইসব বাচ্চা যদি স্কুলে এক বছর বেশি থাকার সুযোগ পায়, তাহলে তাদের গুণ করার ক্ষমতা ২১% বাড়ে। অন্যদিকে ভারতে এটা বাড়ে মাত্র ৬%। এদিকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা মাপার জন্য যেসব জরিপ হয়, সেগুলোর ফল আশাব্যঞ্জক নয়।
গুণগত শিক্ষা অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত শিক্ষায় সমতা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো করলেও ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। শিক্ষায় অসাম্য দূর করার ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম খুব কার্যকর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। সেটা হচ্ছে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে শিক্ষকদের বেশি বেতন দেওয়া, যাতে ভালো শিক্ষকরা কষ্ট করে দূরে গিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নতমানের শিক্ষা প্রদানে উৎসাহিত হন। এ ছাড়া সব স্কুল যেন সমান সুযোগ-সুবিধা পায়, এ ব্যাপারেও ভিয়েতনাম সরকার যথেষ্ট মনোযোগী। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন– লটারিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু, উপবৃত্তি প্রদান, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামো তৈরি করে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে স্কেল চালু করতে পারেনি, ফলে সেসব এলাকায় ভালো শিক্ষকরা যাচ্ছেন না।
ভিয়েতনামের শিক্ষকরা যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক যোগ্য, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারা অনেক বেশি প্রশিক্ষণ পান; একই সঙ্গে স্বাধীনভাবে তাদের সৃষ্টিশীলতা প্রয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশের শিক্ষকরাও যে সামান্য প্রশিক্ষণ বা দিকনির্দেশনা নিয়ে শিখন শেখানো প্রক্রিয়াকে কার্যকর করে তুলতে পারেন– তার প্রমাণ তারা করোনার সময় দিয়েছেন। বিবিএস ও ইউনিসেফের গবেষণা অনুযায়ী করোনার এত বড় ধাক্কাতেও যে বাংলাদেশের মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর খুব একটা ক্ষতি হয়নি, তার মূল নায়ক তো এই শিক্ষকরাই। তবে শিক্ষকদের এই ভূমিকা স্থায়ী হয়নি। করোনার পর কিংবা এখন এই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের এই যোগ্যতা আর তেমন দৃশ্যমান হচ্ছে না। ভিয়েতনামে শিক্ষার এই উন্নতি তাদের অর্থনীতিতে সুফল বয়ে এনেছে। বাংলাদেশেও যে তা হয়নি, তা নয়, তবে ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক কম। আরেকটা বিষয়ে ভিয়েতনামের শিক্ষার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার মিল আছে। সেটা হচ্ছে, এ দুই দেশেই যেভাবে উন্নয়ন হচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ছে না। যেমন এই দুই দেশেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন কোমল দক্ষতাসম্পন্ন (সফট স্কিল) জনবল প্রয়োজন, যা কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সঠিকভাবে সরবরাহ করতে পারছে না।
যা হোক, ভিয়েতনাম থেকে আমরা যে জিনিসটা শিখতে পারি সেটা হচ্ছে শিক্ষা প্রশাসনকে আরও দক্ষ করতে পারলে, ভালো শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে শিক্ষায় আরও সমতা আনতে পারলে, শিক্ষকদের আরও প্রশিক্ষণ ও স্বাধীনতা দিতে পারলে আমাদের শিক্ষকরাও শিক্ষাকে ভিয়েতনামের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তবে ভিয়েতনামের প্রদেশগুলো যেমন তাদের বাজেটের ২০% শিক্ষার পেছনে ব্যয় করে, আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: পিএসসি সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক