নওগাঁ জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। নওগাঁ সদর উপজেলায় দুবলহাটি জমিদার বাড়ি ও বলিহার রাজবাড়ি তাদের মধে অন্যতম।
দুবলহাটি রাজবাড়ি প্রায় দু’শ বছরের প্রাচীন স্থাপনা। এই রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠাতা রাজা জগতরাম রায় ছিলেন এক জন লবণ বিক্রেতা। পরবর্তীতে তৎকালীন জমিদার রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর শাসন কালে দুবলহাটি রাজবাড়ির বিস্তৃতি ছিল সিলেট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও ভারত এর কিছু অংশে। অন্যদিকে, বলিহার জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নৃসিংহ চক্রবর্তী সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক জায়গির লাভ করেন। পরবর্তীতে বলিহারের জমিদাররা এ এলাকায় নানান স্থাপনা গড়ে তোলেন যার মধ্যে বলিহার রাজবাড়ি অন্যতম।
এক সময়ে এই রাজবাড়ি গুলো ছিল লোকে লোকারণ্য। রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, এই রাজবাড়ি গুলো থেকেই রাজ্যের শাসন কার্য পরিচালনা করা হতো। সময়ের ব্যবধানে বিলুপ্ত হয়েছে জমিদার প্রথা। সেই সাথে বিশাল বিশাল এই রাজবাড়ি গুলো হারিয়েছে তাদের জৌলুষ। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকা এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো শুধুমাত্র সেই সময়ের স্মৃতি বহন করছে। সেই স্মৃতি স্বরণ করতে আমরা উপস্থিত হই নওগাঁর দুবলহাটি জমিদার বাড়ি ও বলিহার রাজবাড়িতে।
শুনশান নিরবতা, দু’চার জন স্থানীয় ছাড়া বিশাল এই প্রাসাদে দর্শনার্থী শুধু আমরা ২জন, সম্পূর্ণ প্রাসাদ ঘুরে দেখতে চাই। দুই বছর আগে আমি প্রথম বার এসেছিলাম, এবারে প্রাসাদ গুলি আগের চেয়ে পরিষ্কার লাগছে, দেখে বোঝা গেল ঝোপঝাড় কাটা হয়েছে, আঙ্গিনা ঝাড়ু দেওয়া হয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করলাম আমরা, প্রায় দু’শ বছরের পুরনো প্রাসাদ দেখে মন জুড়িয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম প্রাসাদে কোনার এক কক্ষে বেশ কয়েক জন মানুষের উপস্থিতি! কি যেন করছে, আমরা ঐদিকে যেতে চাইলে আমাদেরকে কক্ষে ঠুকতে নিষেধ করা হয়। আমরা দো’তালার ঐ কক্ষ বাদরেখে বাকি কক্ষ ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ ফেনসিডিলের বেশকিছু খালি বোতল আমাদের নজর কারে, তন্নতন্ন করে দেখতে শুরু করি প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ, কিছু সময়ের ভিতরে বেশ কয়েক ধরণের মাদকদ্রব্যের আলামত দেখতে পেলাম। গাঁজা সেবনের কলকে, ইংজেকশন সিরিজ, পেনটাডল ট্যাবলেটের খালি পাতা সহ হিরোইন অথবা ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম দৃশ্যমান ছিল এই রাজবাড়ী গুলোতে। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধানে আমরা লক্ষ্য করি তিন চার জনের বেশ কয়েকটি গ্রুপ পর্যায়ক্রমে ভবন গুলোর বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করে। এইসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো সময়ের ব্যবধানে মাদক সেবীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদকর্মী রাজিব সেলিম জানান, এই বাড়িগুলো দির্ঘদিনের পুরোনো প্রবেশ করতেই ভয় হয়। যেকোনো সময় ভেঙ্গে পরতে পারে। প্রত্নতত্ব বিভাগের এখনি ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বলিহার রাজবাড়িতো ফাটল ধরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সেজন্য মানুষ প্রবেশ করে না। জনশূন্য বাড়ি তাই সুজগ নিচ্ছে মাদকসেবীরা। প্রায় প্রতিটি কক্ষেই মাদকের ব্যবহার হয় তার চিহ্ন দৃশ্যমান। এই ইতিহাস জেনে নিজেদের বিকশিত করার বদলে বরং মাদকসেবনের জন্য বেছে নিয়েছে মাদকসেবীরা। তবে সংস্কার করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করা হলে যেমন পর্যটক বাড়বে তেমনি রক্ষা করা যাবে বাড়িগুলো। আর মানুষের যাতায়াত বাড়লে মাদকসেবীদের উপদ্রব কমবে।সেই সাথে পুলিশের অভিযান খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে এই পরিত্যাক্ত ভবনগুলোতে।
উওরবঙ্গের সিনিয়র সাংবাদিক মেহেরুল হাসান সুজন জানান, পুরোনো এই স্থাপনা গুলোকে সংরক্ষন করতে হবে। পরবর্তি প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানাতে হলে সংস্কার করেতে হবে। তা না হলে স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে পরবে হারিয়ে যাবে ঐতিহাসিক স্থাপনা। সেই সাথে বাড়িগুলোতে মাদকের ব্যবহার বাড়বে । বাড়বে অন্যান্য অপরাধো। এই স্থাপনা গুলো যদি আগের মত রূপ দেওয়া যেত তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারত যে ইতিহাস কত সমৃদ্ধ ছিল।
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর প্রবণতা। যুব সমাজ নিমজ্জিত হচ্ছে অন্ধকারে। কুফলের দিক জেনেও এক অদৃশ্য শক্তি বশ করছে এ সমাজকে। প্রতিনিয়তই সুস্থ জীবন থেকে সরে যাচ্ছে বহু তরুণ, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। মাদকের টাকার যোগান দিতে প্রায়ই মাদকাসক্তরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে।
স্থানীয় মাদকাসক্ত দের দখলে নওগাঁর দর্শনীয় স্থান সমূহ। প্রশাসন সহ প্রত্নতাত্ত্ব অধিদপ্তর এইসব স্থাপনার সঠিক দেখভাল না করায়, মাদক সেবিদের অভয় আশ্রম হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো। কালের সাক্ষী হয়ে দরিয়ে থাকা সরকারি এই সব স্থাপনা গুলো মাদক মুক্ত করা গেলে নির্বিঘ্নে আসতে পারবেন দর্শনার্থীরা।
নওগাঁর দুবলহাটি জমিদারবাড়ির উওর প্রান্তে বিশাল এক ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে যা প্রায় এক তৃতীয়া অংশ থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে। অপরদিকে বলিহার রাজবাড়িটি এখন কংকাল সার অবস্থায়, ঠিক পিছনের দিকে তিন তলা উঁচু ভবনটির একটি মাএ দেয়াল ঠায় দরিয়ে আছে। মাঝারি থেকে বড় ধরনের ঝর কিংবা ভূমিকম্পে যেকোন সমায় মাটির সঙ্গে মিশে যাবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে যাওয়া প্রাচিণ স্থাপনা গুলো।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষন এবং নজরদারির দাবি জানান এলাকাবাসী।