গত ১৯ এপ্রিল থেকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও চলছে দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার নির্বাচন। বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যটির নির্বাচন নিয়ে ভারতে যেমন, তেমনি বাংলাদেশেও ঔৎসুক্য লক্ষণীয়। যদি বলা হয়, এবার বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যটির লোকসভা নির্বাচন প্রতিটি ধাপে নতুন উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তাহলে ভুল হবে না। লোকসভায় ৮০টি আসন নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করলেও, ৪২ আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব যেন উত্তরপ্রদেশের চেয়েও বেশি। এর মূল কারণ, প্রধানমন্ত্রী নেরন্দ্র মোদির দল বিজেপি টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যেমন মরিয়া, তেমনি দলটি সংবিধানের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য চাচ্ছে সহযোগী দলগুলো নিয়ে আসন সংখ্যা গতবারের ৩০৩ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করতে, যেখানে বিজেপির থাকবে ৩৭০ আসন।
গতবার চরম হিন্দুত্ববাদী এ দলটি উত্তরপ্রদেশসহ হিন্দি বলয়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক আসন পায়। বিশ্লেষকদের মতে, যা আর বাড়ার কোনো জায়গা নেই। তাই মোদির নজর পড়েছে বিশেষত দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর। তবে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজেপির নীতিবিরোধী জনমত প্রবল। তাই সেখানে দলটির মোট আসন বরং আগের চেয়ে কমবে বলে খোদ মোদিরই আশঙ্কা। তাই তাঁর ও তাঁর দলের প্রায় পুরো নজর এখন পশ্চিমবঙ্গে ৩০-৩৫ আসন জেতার কৌশল প্রণয়নে। নির্বাচন শুরুর আগে বিভিন্ন জনমত জরিপেও বলা হয়েছিল, এতটা আসন না পেলেও বিজেপি এবার এ রাজ্যে গতবারের ১৮ আসনের বেশি পেয়ে প্রথমও হতে পারে। কিন্তু তিন দফা নির্বাচনের পর, বিশেষত বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, দলটির সেই আশার গুড়ে যেন বালি পড়তে যাচ্ছে।
অনেকেরই হয়তো জানা আছে, নির্বাচন শুরুর অনেক আগেই বসিরহাট আসনের সন্দেশখালীতে স্থানীয় তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান পরিচালিত অপরাধচক্রের ভয়ংকর সব কুকীর্তি ফাঁস হয়। তাঁর এসব অপরাধের মধ্যে বিশেষত বিজেপি নেতারা ধর্ষণের অভিযোগ সামনে নিয়ে আসেন। মামলায় শাহজাহান আটকও হন। কিন্তু সম্প্রতি স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে তৈরি সন্দেশখালীর বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের একটি ভিডিও ফাঁস হয়েছে; এ নিয়ে পুরো রাজ্যের রাজনীতি এখন উত্তাল। ভিডিওতে কয়াল স্বীকার করেছেন, ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনা পুরোটাই সাজানো। টাকার বিনিময়ে স্থানীয় কিছু নারীকে দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগটি তোলা হয়েছিল। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আরও কয়েকটি ভিডিও ইতোমধ্যে ফাঁস হয়েছে, যেখানে বিজেপি-সংশ্লিষ্ট বেশ ক’জন নারী বলেছেন, বিজেপি নেতারা তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের দিয়ে পুলিশের কাছে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন। সাদা কাগজে সই করিয়ে এসব ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। এসবের ফল হয়েছে এই– স্থানীয় বিজেপি নেতারা এখন দলের উল্লিখিত নেতা ও নারীর বক্তব্য ঢাকতেই গলদঘর্ম।
আরেকটি বিষয় হলো, শুরুতে এ রাজ্যে লড়াই গতবারের মতো তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে মনে হলেও, অন্তত ৬/৭টি আসনে এখন ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বাভাস আসছে। বলা হচ্ছে– তৃণমূল, বিজেপির সঙ্গে লড়বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট) বা সিপিএম ও কংগ্রেস জোট। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর শাসন
করা সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট কোনো আসন পায়নি; কংগ্রেস পায় মাত্র দুটো আসন। কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এমনও মনে করেন, এবার বাম-কংগ্রেস জোট ওই ৬/৭টি আসন জিতে গেলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের পর থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কয়েক দফা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাসহ বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগে দুর্নীতি এবং কয়লা, গরু পাচারসহ নানা অভিযোগে দলটির একাধিক মন্ত্রী ও নেতা এখন জেলে। এরই মধ্যে যুক্ত হয় সন্দেশখালী বিতর্ক। ফলে দলটির সমর্থন এখন ২০২১ সালের পর্যায়ে নেই বলে অনেকের ধারণা। তৃণমূলের ভোটব্যাংক বলে পরিচিত মুসলমান সমাজও একাট্টা হয়ে তার পেছনে নেই। অন্যদিকে চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলিমের কাছে বিজেপি এমনিতেই ব্রাত্য। তার ওপর রয়েছে সন্দেশখালী নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের পাল্টা হামলা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইতোমধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া রাজ্যগুলোতে বিজেপি কাঙ্ক্ষিত ভোট না পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। সেটিও ভারতের অন্যান্য অংশের মতো পশ্চিমবঙ্গে দলটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। সব মিলিয়ে শুরুতে এ রাজ্যে যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল দলটির, তা সংকটে পড়েছে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ঘোষণামতে, শেষ দফা ভোট হবে ১ জুন। ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে ৪ জুন পর্যন্ত। দেখা যাক– শেষ হাসি কে হাসে।