দু’দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফল। এবার পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারায় উল্লসিত শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। তবে শুধু ভালো ফল করেই নির্ভার থাকতে পারছেন না তারা। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন দুশ্চিন্তা। পরীক্ষায় ভালো ফলের পর এবার তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। যদিও সারাদেশে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর চেয়ে সর্বমোট আসন অনেক বেশি কিন্তু আসন সঙ্কট রয়েছে ভালো মানের কলেজে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে একাদশ শ্রেণিতে আসন রয়েছে ২৫ লাখ। উত্তীর্ণ হয়েছে ১৭ লাখেরও কম শিক্ষার্থী। ফলে বিভিন্ন কলেজে ৮ লাখের বেশি আসন ফাঁকা থাকবে। কিন্তু প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ হবে রাজধানীসহ সারাদেশের নামী কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে ভালো ফলাফল করা সকল শিক্ষার্থীর টার্গেট থাকে রাজধানীর শীর্ষ কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার। শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে চাহিদার চেয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি। তবে সব প্রতিষ্ঠানই মানসম্পন্ন নয়। মানহীন কলেজে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই ভর্তি হতে চাইবে না। এগুলোই শিক্ষার্থীর সংকটে পড়বে। অনেক কলেজই থাকবে যেখানে কোনো শিক্ষার্থী নাও পেতে পারে, আবার পেলেও তা নামমাত্র সংখ্যায়। তাই শিক্ষার্থী ধরে রাখতে হলে বা শিক্ষার্থী ভর্তিতে আকৃষ্ট করতে হলে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে মানের দিকে নজর দিতে হবে বেশি।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এবার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু হবে আগামী ২৬ মে থেকে, চলবে ১১ জুন পর্যন্ত। এবারও একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে নির্ধারিত ওয়েবসাইটে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করতে পারবে। একজন শিক্ষার্থী ১০ কলেজ বা মাদরাসায় আবেদন করতে পারবেন, তার মধ্য থেকে তার মেধা, কোটা ও পছন্দক্রমের ভিত্তিতে একটি কলেজে তার অবস্থান নির্ধারণ করা হবে। ভর্তি নীতিমালায় এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে নটর ডেম, হলিক্রস, সেন্ট জোসেফ কলেজ ও সেন্ট গ্রেগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করবে।
শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই ভালো মানের কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হয়। আর অনেক কলেজে আসন ফাঁকা থাকে। কারণ এই পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। এ ছাড়া জিপিএ ৪ থেকে ৫-এর নিচে পেয়েছে পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪৯ জন। এই সাত থেকে আট লাখ শিক্ষার্থীই ভালো কলেজে ভর্তি হতে চায়। আর সারা দেশে ভালো মানের কলেজ হিসেবে পরিচিতি প্রায় ২০০টি। যেগুলোতে সব মিলিয়ে আসন হতে পারে এক লাখের মতো। এ ধরনের ২৫-৩০টির মতো কলেজ ঢাকায় অবস্থিত। এগুলোতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিযোগ্য আসন আছে কমবেশি ৫০ হাজার। তবে এগুলোর কয়েকটিতে বিদ্যালয় শাখা আছে। নিজ নিজ কলেজ থেকে কম জিপিএ পেলেও ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন এসএসসিতে উত্তীর্ণরা। সে হিসেবে রাজধানীর নামী-দামি কলেজগুলোতে এবারও ভর্তির ক্ষেত্রে ভিড় থাকবে দেশ সেরা মেধাবীদের। এর মধ্যে নটর ডেম কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস কলেজ, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, সিটি কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাপ বেশি হবে। বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং কিছু জেলা শহরে এ রকম কিছু কলেজ আছে। ফলে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সাফল্য জিপিএ-৫ পেয়ে ৮২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পছন্দের কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবেন না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত ঢাকা মহানগরের কলেজে ভর্তিতে বেশি সঙ্কট সৃষ্টি হয়। মেধাবীরা নির্দিষ্ট কিছু কলেজে ভর্তির আবেদন করে। এতে অনেকেই ভর্তিবঞ্চিত হয়।
প্রফেসর মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, কোনটির বিগত ফলাফল কি সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। এজন্য এখন বাসায় বাসায় গিয়ে মার্কেটিং করে কলেজগুলো শিক্ষার্থী টানতে পারছে না। তিনি বলেন, একই মহল্লায় একাধিক কলেজ কেন থাকবে? এখন টাকা হলেই একটি স্কুল-কলেজ খোলা যায়। ওটা প্রস্তাবিত এলাকায় দরকার আছে কী নেই, সেটা যাচাই করার চেয়ে দেখা হয় এটা কোন এমপি-মন্ত্রীর দাবি ইত্যাদি।
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সবসময় সঙ্কট সৃষ্টি হয় ঢাকা মহানগরীর কলেজগুলোতে। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের টার্গেট থাকে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। তাই হাতেগোনা কিছু কলেজেই প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এদিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাস করেছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ হাজার ১৯০ জন। এই বোর্ডের অধীনে কলেজে যদিও একাদশ শ্রেণিতে আসন আছে ৫ লাখের বেশি। তবে রাজধানীকেন্দ্রিক শীর্ষ কলেজগুলোতে তা প্রায় ৫০ হাজারের মতো। ফলে আগ্রহ-স্বপ্ন থাকলেও ভালো মানের কলেজে পড়া হবে না জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীর।
জানা যায়, ঢাকার শীর্ষ কলেজগুলোর মধ্যে নটর ডেম কলেজে তিন হাজার ২৭০, ঢাকা কলেজে এক হাজার ২০০, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে এক হাজার ৭০৪, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুই হাজার ৩৭৬, হলি ক্রস কলেজে এক হাজার ৩৩০, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে দুই হাজার ২০০, শহীদ বীর-উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক হাজার ১২০, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে এক হাজার ১৪, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক হাজার ১৬৫ ও বিএএফ শাহীন কলেজে এক হাজার ২২০টি, ঢাকা সিটি কলেজে তিন হাজার ৭৬২, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ পাবলিক কলেজে এক হাজার ৯৮০, ঢাকা কমার্স কলেজে চার হাজার ৭০০, বাংলাদেশ নেভি কলেজে ৯৫০ ও শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে ৮৮০টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
তবে ভর্তিচ্ছুদের কাছে প্রতি বছর বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের আরও শতাধিক কলেজ আকর্ষণীয় থাকে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৭০টি, রংপুর বিভাগে ৩২টি, বরিশাল বিভাগে ১৪টি, রাজশাহীতে ৭, চট্টগ্রামে ১৯, খুলনায় ১৩ এবং সিলেট বিভাগে ২৩টি। এ ছাড়া সারা দেশে অর্ধশত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে আছে। শিক্ষার্থীদের অতীতের ভর্তির আবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের বাইরে মাদরাসা এবং কারিগরি বোর্ড থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও ভর্তির আবেদন করবেন।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বলেন, ‘একাদশ শ্রেণিতে আমাদের আসনের কোনো সংকট নেই। বরং আমাদের হিসাবে আট লাখের বেশি আসন খালি থাকবে। কিন্তু শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পছন্দ অল্প কিছু কলেজ। ফলে সেখানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়। এমনকি জিপিএ ৫ পেয়েও অনেক শিক্ষার্থী প্রথম ধাপে পছন্দের কলেজ পায় না। তাই আমি সব শিক্ষার্থীকে বলব, তারা যেন আবেদনের সময় ১০টি কলেজই পছন্দক্রমে রাখে।’
তিনি বলেন, সরকার নামসর্বস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কঠোর। আসনের চেয়ে কম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানের আসন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী কম ভর্তি হলে আসন কমিয়ে দেওয়া, বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত আমরা নেব।