সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বঙ্গোপসাগরের অরক্ষিত উপকূল ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ ঘর বাড়ি। নষ্ট হয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি। পানিতে ভেসে গেছে হাজার হাজার মাছের ঘের। বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে অন্ধকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ জেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। বিভিন্ন জেলার তথ্যানুযায়ী ২ লাখের বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুরের মাছ। উপকূলবাসীর চোখে মুখে এখনো ভয়াবহ রিমালের অতঙ্ক। প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির তাণ্ডবে রাজধানীসহ ১০ জেলায় প্রাণ গেছে ২১ জনের। এর মধ্যে রাজধানীতে চারজন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। আর ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, চট্টগ্রামে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের টানা ২০ ঘন্টার তান্ডবের ক্ষত সুন্দরবনের বুকে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বুক পেতে জনপদকে রক্ষা করা বনের বিভিন্ন স্থানে উপড়ে গেছে গাছপালা। জলোচ্ছ্বাসে টানা প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে পানিতে নিমজ্জিত ছিল সুন্দরবন। বনের অভ্যন্তরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবণ পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে অন্তত ৮০টি মিষ্টি পানির পুকুর। মিলছে হরিণের মরদেহ। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৬টি হরিণের মরদেহ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এ ছাড়া বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদে ভেসে আসা তিনটি হরিণের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রথম আঘাত হানে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ধসে গেছে উপজেলার ৫৪১টি কাঁচা ঘরবাড়ি। শ্যামনগর ও আশাশুনিতে জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ উপচে এবং প্রবল বর্ষণে শত শত মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা শহর বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসেবে জেলার প্রায় ৫০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে হাজার-হাজার গাছপালা। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো জেলার সাড়ে ৪ লক্ষ পরিবার। জলোচ্ছ্বাসে জেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৫০ হাজারের অধিক পরিবার। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে মোংলা, রামপাল, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট সদর উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুরের মাছ। এতে কমপক্ষে ৭৫ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমির ফসলছ। খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলায় কমপক্ষে ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কয়রা উপজেলার ৩টি জায়গার অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের, ভেঙে গেছে কয়েকশ’ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশালে রিমালের তান্ডবে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। রিমেলর ছোবলে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সহ নদী তীর রক্ষা বাঁধের ক্ষতিও ব্যাপক। বরিশালে বিএডিসি’র প্রায় হাজার টন ইউরিয়া সার কীর্তনখোলা নদীর জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে বিনষ্ট হয়েছে। বরিশালের চালপট্টির বিভিন্ন আড়তে প্রায় ২৫ কোটি টাকার চাল ফুসে ওঠা কীর্তনখোলার জোয়ারে প্লাবিত। মাঠে থাকা পাকা বোরো ধান ছাড়াও সদ্য রোপণকরা আউশ ও তার বীজতলা জোয়ার আর বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় আরো একবার কৃষকের স্বপ্ন মাটিতে মিশে গেছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৭৬ হাজার ৯০৪টি এবং গাছ চাপায় নিহত হয়েছেন একজন। জেলার ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার ৭০০ ঘর সম্পূর্ণ ও ৫৬ হাজার ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৫২টি ওয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। খুলনা নগরীতেও অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় চলাকালে সোমবার রাত ১টার দিকে জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় সুরখালি ইউনিয়নে নিজ ঘরে গাছচাপা পড়ে গাওঘরা গ্রামের গহর আলী মোড়লের ছেলে লাল চাঁদ মোড়ল নিহত হয়েছেন। এছাড়া জেলার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় কয়েক হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে এবং ভেঙে পড়েছে। ছোট বড় শত শত মাছের ঘের, পুকুর এবং ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট। অনেকের গবাদিপশু, গৃহস্থলীর আসবাবপত্র জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। গত সোমবার দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে অনেক এলাকায়। এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন হাজার হাজার মানুষ।
পটুয়াখালী জেলা সংবাদদাতা জানান, পটুয়াখালী পৌরএলাকা এক বিধ্বস্ত নগরীতে রুপ নিয়েছে। শহরের প্রধান বড় সড়ক বিখ্যাত সেলফি রোড সহ জেলা প্রশাসকের বাসভবন, সার্কিট হাউজ সড়ক যেগুলি শহরের উঁচু এলাকায় রেমালের প্রভাবে পানিতে নিমজ্জিত। এ ছাড়াও শহরের সবকয়টি রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যায়, বন্ধ করে দিতে হয় শহরের টিবি ক্লিনিক সড়কটি অতিরিক্ত পানিতে তলিয়ে থাকার কারনে। এমনকি শহরের প্রধান সড়কে জাল দিয়ে মানুষ মাছ ধরে, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের আশেপাশে সহ শহরের সব এলাকায় গতকাল ঝড় থেমে যাওয়ার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাছ ধরতে দেখা যায় অনেক লোককে। পটুয়াখালী পৌর সভার নির্বাহী প্রকৌশলী জসিমউদ্দিন আরজু বলেন, পৌর এলাকার ৬ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এর মধ্যে অনেক রাস্তার কার্পেটিং ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পানিবদ্ধতা কারনে। পানির লাইন সহ ১৯টি গভীর টিউবওয়েল ডুব গিয়েছে, শহরকে আলোকিত করতে ফোরলেনের বিদ্যুৎ লাইনে ক্ষতি হয়েছে, অনেক এলাকার বিদুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে লাইনে গাছ পড়ার কারনে।
মোংলা সংবাদদাতা জানান, রিমালের আঘাতে মোংলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকার পর গতকাল দুপুর ১টার দিকে বিদু্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে হরিণসহ অন্যান্য প্রাণী। বনের কটকা ও দুবলা এলাকা থেকে ২টি মৃত হরিণসহ আরও ৯টি আহত হরিণকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করেছে বনরক্ষকীরা। এছাড়া রিমেলের তান্ডবে বনের অভ্যন্তরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবন পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে অন্তত ৮০টি মিষ্টি পানির পুকুর। জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন জানান, বাগেরহাট জেলায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের দুর্ভোগ লাগবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ।
ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে ঘরের উপরে গাছ চাপায় এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। গত সোমবার ভোর রাতে উপজেলার বালিপাড়ার উত্তর ঢেপসাবুনিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল গফফার এর ছেলে আসাদুজ্জামান বাচ্চু জানান, ঢেপসাবুনিয়া গ্রামের মৃত আশ্রাব আলী মোল্লার স্ত্রী চানবরু বিবি ওই রাতে ঘরে ছিলেন। এমন সময় প্রচন্ড বাতাসে বাড়ির উঠানে থাকা চাম্বল গাছ ঘরের উপরে পড়লে ঘরটি বিধ্বস্ত হয়। তাই জলোচ্ছ্বাসে সব জলাধার প্লাবিত হওয়ায় এখানে খাবার পানির তীব্র সঙ্কট চলছে। এছাড়া উপজেলার অধিকাংশ বাড়িতেই এখন পর্যন্ত রান্না করার মতো কোন পরিস্থিতি নেই। রান্নার চুলা এখনো পানিতে ডুবে আছে। আছে জ¦ালানীর অভাব। আবার সব গ্রাম থেকে পানি এখনো নামে নাই। বেড়ি বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। অভুক্ত মানুষের হাহাকার দেখা দিয়েছে উপজেলা জুড়ে। বিদ্যুৎ বিহীন হয়ে পড়েছে সমগ্র উপজেলা। মোবাইল নেটওয়ার্কও দূর্বল এখানে। ঝড়ো হাওয়ায় ভেঙেছে অনেক গাছ। তলিয়ে গিয়েছে মাছের ঘের ও কৃষি ক্ষেত। দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় অনেক বসত ঘরের চাল। গাছ চাপায় বিধ্বস্ত হয় অগনিত ঘর বাড়ি। ইন্দুরকানীর উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসান গাজী জানান, আমার নিজস্ব তহবিল থেকে সকল আশ্রয়ন কেন্দ্রে নগদ অর্থসহ খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। তারপরেও এখানে আরো ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। উপজেলার বেড়ি বাঁধ গুলোর ৯৫ ভাগ বিলিন হয়ে গিয়েছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপকূলে ঘূর্নিঝড় রিমালের তান্ডবে দুর্গত এলাকার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়ী ঘরে ফিরলেও এখনও আতংক যেন তাদের পিছু ছাড়েনি। সমুদ্র উপকূল ও নদীপাড়ের গ্রাম গুলোতে শুধু ধ্বংসের ছাপ। অনেকের রান্নার চুলা আজও জ্বলেনি। জ্বলোচ্ছাসের আঘাতে নদীপাড়ের দুর্গত এসব পরিবারের যেন কান্নার শেষ নেই। উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের জীবন যাত্রা সচলে দুর্যোগ অধিদফতর, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা দিন রাত কাজ করে চলেছেন।
চরফ্যাশন (ভোলা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, উপকূলীয় উপজেলা চরফ্যাশনে গবাদি পশু, ফসলী জমি, মাছের ঘেড়, বেড়িবাঁধ, কাঁচা পাকা, হেরিংবন রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও ঝড়ের তান্ডবে অর্ধ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। সরকারি বেসরকারিভাবে এতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া সকল ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে এবারের ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব ছিল নজিরবিহীন। ২দিন ব্যাপী উপকূল জুড়ে রিমাল তান্ডব লীলা চালালে কোন মানুষের প্রাণ হানি না ঘটলেও ক্ষতির পরিমাণ ছিল অতীতের তুলনায় রেকর্ড। ঝড়ে চরাঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার বসত ঘর উপড়ে পড়েছে।
সদরপুর (ফরিদপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল। মঙ্গলবার সকাল সাড় ১১টায় বিদ্যুৎ এলেও অত্যধিক লো-ভোল্টেজের কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বেলা আড়াইটায় বিদ্যুতের ভোল্টেজ স্বাভাবিক হয়। এদিকে আজ ৬ষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে সদরপুর উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ঝড়োবৃষ্টির মধ্যে প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। নির্বাচনে ৬৮টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সদরপুর ইউনিয়ন এলাকায় গাছ উপড়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও গাছের ডাল ভেঙে যোগাযোগ ব্যাহত হয়েছে। দূর্গম চরাঞ্চল নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নে আটটি কাঁচা টিনের ঘর ভেঙে পড়ে।
নাটোর জেলা সংবাদদাতা জানান, ঘনাটোরে প্রাণ হানি না ঘটলেও গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে নাটোর সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় গাছপালা ভেঙে পড়েছে, বৈদ্যুতিক তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক স্থানে, ভেঙে পড়েছে বেশ কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটিও। ঝোড়ো হাওয়ায় ঝরে পড়েছে আম, লিচু। হেলে পড়েছে ভুট্টা গাছ।
স্টাফ রিপোর্টার, রাঙামাটি থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে রাঙামাটিতে অতিবৃষ্টিতে বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তত তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া সড়কে গাছ পড়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল মঙ্গ দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিরীণ আক্তার। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা ও অতিবর্ষণে পাহাড়ি ঢল নেমে কাঁচালং নদীর পানি বেড়ে উপজেলার মধ্যমপাড়া, মাস্টারঘোনা, লাইনাপাড়ার প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও মারিশ্যা বাঘাইছড়ি সড়কের ৪ থেকে ১২ কিলোমিটার এলাকায় গাছ পড়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে গাছ সরানোর কাজ শুরু হয়েছে।
পাথরঘাটা (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, উপজেলায় ৫৮ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন জীবন যাবন করছেন। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরো ৪ থেকে ৫ দিন লাগতে পারে বলে জানিয়ছেন পাথরঘাটা উপজেলা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আবদুছ ছালাম। বিদ্যুৎ না থাকার কারনে অসংখ্য ব্রয়লার মুরগী খামারী ও দুগ্ধ খামারীসহ বেশ কিছু উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী চিরতরে নিঃশ্ব হতে পারে।
লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, লৌহজংয়ে শতাধিক বসতঘর ও সোয়া দুইশ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত রোববার থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির কারণে উত্তাল পদ্মা নদীর প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে নদীর তীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প এলাকায় জিও ব্যাগ সরে গিয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সোমবার (২৭ মে) রাতে গাঁওদিয়া ইউনিয়নে শিমুলবাড়ি এলাকায় তিনটি বসতঘর নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। অনেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়ে গেছে। অনেকে নিকটস্থ আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে৷
স্টাফ রিপোর্টার, লক্ষ্মীপু থেকে জানান, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বড়খেরী এলাকার মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে ধস নেমেছে। সোমবার শেষরাত পর্যন্ত রিমালের প্রভাবে ঝড়-বৃষ্টি এবং জোয়ারের তোড়ে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে অন্তত নয়টি গর্ত হয়েছে। বাঁধটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রামগতি বাজার ভাঙন ঝুঁকিতে পড়বে। এদিকে বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছেন। ভাঙন ঠেকাতে বিধ্বস্ত স্থানে জিওব্যাগ এবং ব্লক বসিয়েছেন তারা।
কলারোয়া (সাতক্ষীরা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, রিমালের আঘাত ও প্রবল বর্ষণে হাজার হাজার মণ শাকসবজি, আম, জাম ক্ষতি হয়েছে। কিছু ঘরবাড়ি সহ শতশত গাছপালা ভেঙে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে ভূতুরে জনজীবন চরম দুর্ভোগে। এছাড়া কৃষকরা গাছের গোড়ায় পানি জমার কারণে বেগুন সহ অন্যান্য সবজি ক্ষতির আশাংকা করছে। বিভিন্ন এলাকা কিছু ঘর বিধস্ত হয়েছে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত রিমালের তাণ্ডবে একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতটি বঙ্গোপসাগর থেকে ফুঁসে ওঠা জলোচ্ছ্বাসে ডুবে আছে। কুয়াকাটা সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যান, পর্যটন পার্ক, লেম্বুর চর, শুঁটকিপল্লি এলাকা জোয়ারের চাপে ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝুঁকির মুখে পড়েছে সৈকতে নামার রাস্তার পাশে অবস্থিত পর্যটন পুলিশ বক্স, এর পাশের চা-পানের দোকানসহ বেশ কিছু স্থাপনা। সৈকতে নামার প্রধান সড়কটি জোয়ারের চাপে অন্তত ২০ ফুট ভেঙে বিলীন হয়েছে। কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যান, পর্যটন পার্ক-সংলগ্ন এলাকার কয়েক শ ঝাউগাছ, নারিকেলগাছ উপড়ে পড়েছে। সৈকতের জোয়ারের পানিতে লাশের মতো গাছগুলো পড়ে আছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে কুয়াকাটা সহ পটুয়াখালীর জেলার প্রতিটি ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখনো পানিবন্দি রয়েছে হাজার হাজার পরিবার। উপকূলের অনেক স্থানে এখনো ভারী থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে বাতাসের চাপ নেই বললেই চলে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তান্ডবে গত দুই দিনে জেলায় মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। এদিকে অতি বর্ষণে কুয়াকাটা পৌরসভার পশ্চিম কুয়াকাটা, মাঝিবাড়ি, তুলাতলী, নবীনপুর, রাখাইন মহিলা মার্কেট এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের জনজীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তথ্যমতে, জেলায় ৯১০৫ টি পুকুর,৭৬৫ টি মাছে ঘের এবং ১২০টি কাঁকড়া ঘের প্লাবিত হয়েছে। এতে মৎস্য চাষিদের ১৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া জেলায় ৩৫০০ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে জেলায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ২৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা।
গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) উপজেলা সংবাদদাতা : উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে উপজেলা সদরে দুইটি ফিডার ছাড়া কোন এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। শহরের বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় ফলে গ্রাহকদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। সকল ধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ঝড়ে গাছ-পালা রেলের উপরে পড়ে গেছে। ফলে ট্রেন যোগাযোগ বিঘ্ন ঘটেছে।
দাউদকান্দি (কুমিল্লা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, দাউদকান্দিতে জলবদ্ধতা ও গাছের ডালপালা ভেঙে বসত ঘরের উপর পড়ে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও চলাচলের বিঘ্ন ঘটেছে। এছাড়া দাউদকান্দি পৌর এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পৌরবাসী চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাটে ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছের ডালপালা সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
স্টাফ রিপোর্টার, চাঁদপুর থেকে জানান, চাঁদপুরে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছপালার ডাল ভেঙে বিদ্যুৎ সংযোগের ওপর পড়ে। একাধিক বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে।
বরগুনা জেলা সংবাদদাতা জানান, বরগুনায় ঘর, ফসলি জমি, মাছের ঘের ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গেছে। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকেই বিদ্যুৎ গ্রামাঞ্চলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরের কিছু স্থানে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়া হলেও জেলার ছয়টি উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। সবকিছু সচল করতে মাঠে কাজ করছে প্রশাসন। রিমালে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হাজারো পরিবারের সদস্যগণ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বরগুনায় অন্তত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১৩ হাজার ৩৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদরের আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়নের লেমুয়া গ্রামের আ. রহিম বয়াতী নামাক এক ব্যক্তি গাছচাপায় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। জলোচ্ছ্বাসে বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যশোর ব্যুরো জানায়, যশোরের তিন হাজার ৭৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই রয়েছে সবজি ক্ষেত। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এ তথ্য জানিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সারাদিন যশোরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। সেই সাথে রাত থেকেই ঘূর্ণিঝড় হয়। রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে শুরু হয় মুষলধারের বৃষ্টি। এই ঝড়-বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফসলের ক্ষেত। যার পরিমাণ তিন হাজার ৭৪ হেক্টর। এরমধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪২৯ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সবজির মাচা ভেঙে ও বৃষ্টির পানিতে ডুবে সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, বান্দরবান থেকে জানান, প্রবল বর্ষণে বেইলি ব্রিজ দেবে যাওয়ায় ২টি উপজেলার সাথে বান্দরবান জেলা সদরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এলাকাবাসী জানান, বান্দরবানের চিম্বুক সড়কের লাইমী পাড়াএলাকায় একটি লোহার বেইলি ব্রিজ দেবে গেছে। ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় গতকাল সকাল থেকে বান্দরবানের সাথে রুমা ও থানচি উপজেলার সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্রবল বর্ষণের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি। বিভিন্ন জায়গায় গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বান্দরবানে। এ ছাড়া পাহাড় ধসের আশংকায় নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য জেলা প্রসাশনের পক্ষই থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে
আরিচা সংবাদদাতা জানান, আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও ধাওয়াপাড়া-নাজিরগঞ্জ নৌ-রুটে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার পর গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে চলাচল শুরু হয়। এছাড়া এসব রুটে লঞ্চ, স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযান প্রায় ৩৮ ঘন্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল বেলা ১২টায় আবার চলাচল শুরু হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরিচা বন্দরের ট্রাফিক সুপারভাইজার আফছার আলী এ তথ্য জানান।