কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন কর্তব্যরত অবস্থায় এক পুলিশ সদস্যের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছেন আরেক পুলিশ সদস্য। গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে বারিধারায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ একজন পথচারিও। যিনি জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক। ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি। কূটনৈতিকপাড়ায় নিরপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনার কারন এখনো অজানা। পুলিশের সাবেক একজন আইজিপি বলেন, পুলিশে এখন তদারকি কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু উপর মহলের নির্দেশে তারা বিরোধী রাজনীতিবিদদের হয়রানিতেই যেন বেশি ব্যস্ত। অস্ত্রধারী ফোর্সদের দিকে যথাযথ নজরদারি না থাকা দুংখজনক।
সংশ্লিষ্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহত কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম পুলিশের ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার রাতে ফিলিস্তিন দূতাবাস লাগোয়া উত্তর পাশের গার্ড রুমে তার ডিউটি ছিল। একই সময়ে সেখানে ডিউটিরত ছিলেন কাওসার আহমেদ।
ঘটনাস্থলের পাশ থেকে উদ্ধার করা কেøাজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজে দেখা যায়, ফিলিস্তিন দূতাবাসের ডিউটি বুথের সামনে ডিউটি খাতা নিয়ে তারা বাগবিত-া করছেন। এ সময় হঠাৎ করেই মনিরুলের দিকে ডিউটি খাতাটি ছুড়ে দেন কাওসার। এখানেই শেষ নয়, মনিরুলের দিকে তাক করে আচমকা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন তিনি। পরে বুথ থেকে বের হয়ে আবারো কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মনিরুলের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ সময় মনিরুলের অস্ত্রটিও হাতে তুলে নিয়ে তার দেহ লক্ষ্য করে গুলি করেন। মনিরুল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন। তার পিঠের ওপর মনিরুলের অস্ত্রটিই রেখে দিয়ে কাওসার অনতিদূরে দাড়িয়ে থাকেন।
মনিরুলকে যেখানে গুলি করে হত্যা করা হয় সেটি দেশের একটি অত্যন্ত নিরাপদ ও স্পর্শকাতর জায়গা। এখানে রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রের দূতাবাস। ঘটনাটি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে হলেও পাশে রয়েছে চীন ও জাপানের দূতাবাস। ঘটনাস্থল থেকে একটু দক্ষিণ দিকে এগোলে রয়েছে তুরস্ক, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। ঘটনাস্থলের উত্তর দিকে রয়েছে যুক্তরাজ্যের দূতাবাস। এমন একটি এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটায় কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনার পরপরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। বন্ধ করে দেয়া হয় ওই সড়কে যান চলাচল। প্রায় আধা ঘণ্টার চেষ্টায় কনস্টেবল কাওসারকে নিরস্ত্র করা হয়। ছুটে আসে পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট, গোয়েন্দা শাখাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। স্থানীয়রা কাওসারকে আটক করে। পরে তাকে নেয়া হয় গুলশান থানা হেফাজতে। তিনি কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাগলের মতো আচরন করতে থাকেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আসলে ঘটনাটা কি কারণে ঘটেছে সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি।
তবে ডিএমপির ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুল ইসলাম সরকার বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে কাউসার আলী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। প্রাথমিকভাবে আমরা আক্রমণকারী পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি সে পাঁচ, ছয় দিন থেকে খুব চুপচাপ ছিলেন। তার অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলছিলেন না।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহা-পরিদর্শক এম এ ইনকিলাবকে বলেন, এ ঘটনা আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। একজন অস্ত্রধারী ফোর্স লম্বা সময় ধরে সতর্ক থাকতে পারেনা। এতে তার মনোযোগ ও স্বাস্থ্যগত সমস্যাও হতে পারে। অস্ত্রধারী ফোর্সদের যথাযথ সুপাভাইজিং এবং ক্লোজ মনিটরিং বাধ্যতামূলক। তাদের কল্যাণ এবং জনগনের নিরাপত্তার স্বার্থেই এসব ফোর্সদের মানষিক স্বাস্থ্য, উপযুক্ত খাওয়া-দাওয়াসহ সার্বিক তদারকির পাশাপাশি শাসন দরকার। পুলিশে এখন তদারকির সংখ্যা বাড়লেও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যস্থ উপর মহলের নির্দেশনায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানি করতে। ব্যক্তিগত দুর্নীতি কিছু কিছু কর্মকর্তার কালচারে পরিনত হয়েছে। লাগামহীন এ দুর্নীতির প্রভাব নিচের দিকে সংক্রমিত হবার প্রবনতা বাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মনিরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করার পর কাওসার ঘটনাস্থলে আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। কিছু সময় তিনি দূতাবাসের সামনে বসেছিলেন। মনিরুলের লাশ পড়ে থাকতে দেখে এক পথচারি ঘটনা জানতে চাইলে তাকেও গুলি করেন কাওসার। গুলিবিদ্ধ ওই পথচারির নাম সাজ্জাদ। তিনি জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে। গুলি সাজ্জাদের পেট ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।
পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ডিপ্লোমেটিক জোনে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সদস্যদের হাতে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হেভি অস্ত্র দেওয়া হয়। কাওসার এই অস্ত্র দিয়ে উন্মাদের মতো এরেঅপাতাড়ি গুলি করেছে। ঘটনাস্থল থেকে ২০ রাউ- গুলি ও গুলিশ খোসা উদ্ধার করা হয়।
গত ২৬ বছর ধরে এ্যাম্বেসী এলাকায় পুলিশ সদস্যের একটি রোষ্টার ছিলো। যেখানে দৈনিক টানা ৬ ঘন্টা ডিউটির নিয়ম ছিলো। গত ২/৩ মাস ধরে সেই রোষ্টার পরিবর্তন করে একজন পুলিশ সদস্যকে ৮ ঘন্টা ডিউটি শেষে ৮ ঘন্টা বিশ্রাম আবার টানা ৮ ঘন্টা ডিউটির নিয়ম করা হয়। এতে করে একজন পুলিশ সদস্যকে দৈনিক ১৬ ঘন্টা ডিউটি করা লাগে। যে কারনে তাদের মেজাজ কিছুটা খিটেখিটে হতে পড়ে।
থানায় মামলা, রিমান্ডের আবেদন ঃ পুলিশ সদস্য মনিরুলের নিহতের ঘটনায় তার বড় ভাই মাহাবুবুল আলম বাদী বাদী হয়ে কাওসারকে আসামি করে গতকাল রোববার গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মাহাবুবুল নিজেও পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করেন। মনিরুল ২০১৮ সালে পুলিশ বাহিনিতে যোগ দেয়। কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়ায়।
এদিকে ঘটনার পর পরই মনিরুলের লাশ ময়না তদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। গতকাল তার ময়না তদন্ত শেষে লাশ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই মামলায় কাওসারকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত ৭ দিনের রিমা- মঞ্জুর করেন। কাওসারের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। এরই মধ্যে আদালতে তাকে হাজির করা হয়েছে।
গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, কাওসার দীর্ঘদিন পুলিশে কর্মরত। ঘটনাটি স্পর্শকাতর। এই অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে তিনি জানেন বলেই কৌশলগত কারনে পাগলের বেশ ধরতে পারেন। থানা হেফাজতে কাওসারকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কিন্তু নিরুত্তাপ কনস্টেবল কাউসার।আমরা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করব। তারপর বলা সম্ভব, ঘটনার আসল মোটিভ।
মনিরুলের লাশের সুরতহাল করেন গুলশান থানার এসআই আব্দুল মান্নাফ। পরে লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মনিরুলের শরীরে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়। মাথার বাঁ পাশে একাধিক গুলির চিহ্ন ছিল। বাঁ চোখ, বাম হাতের বাহু, ডান হাতের কনুই, গলার নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত বুকে, পেটে, পিঠে বিভিন্ন ¯’ানে গুলির ক্ষত রয়েছে। গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, টরাস এসএমটি সাবমেশিন গান দিয়ে কাউসার গুলি করেন। তার কাছে দুটি ম্যাগাজিন ছিল। প্রতিটা ম্যাগাজিনে ৩০টি করে ৬০ রাউন্ড গুলি থাকে। একটা ম্যাগাজিন শেষ হওয়ার পর আরেকটা ম্যাগাজিন অস্ত্রে লাগিয়ে ৮ রাউন্ড গুলি করে। পরের ওই ম্যাগাজিন থেকে ২২ রাউন্ড তাজা গুলি পাওয়া গেছে।