মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দখলদার আওয়ামী সরকার ও তাদের গুরুদের মাঝে ভাগাভাগির এক সুনির্দিষ্ট ইজারাপত্র বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। পাশাপাশি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে ‘বাজেট প্রত্যাখ্যান’ করেছে দলটি। গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বিএনপি’র আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।
কালোটাকা সাদা করার বাজেট: এই বাজেট কালোটাকাকে সাদা করার বাজেট বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কালোটাকায় ঢালাও দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ১৫% কর দিয়ে ব্যক্তির সঙ্গে যেকোনো কোম্পানিকেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সরকারের কোনো সংস্থাই কালোটাকা সাদাকারীদের কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারবে না। এর ফলে সৎ ও বৈধ আয়ের করদাতাদের নিরুৎসাহিত এবং দুর্নীতিকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হলো। দুর্নীতি করার এহেন লাইসেন্স প্রদান অবৈধ, অনৈতিক ও অসাংবিধানিক।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বাজেটে নিজস্ব কোনো কিছুই নাই। আর ঘাটতি বাজেট তো বটেই। আর সেই ঘাটতি মেটানোর কোনো কিছুই নেই। সুতরাং এটা একটা অযৌক্তিক এবং জাতিকে প্রতারণা করা ছাড়া আর কিছুই না।
আর বিএনপি’র শাসনামলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল কি না, সেটা ঠিক আমার মনে নেই। এটা ছিল অপ্রদর্শিত আয়, আপনি আয় করেছেন কিন্তু সঠিকভাবে দেখাননি। এটা ছিল হয়তো বা। আমি নিজেও বিষয়টা পরিষ্কার না।
তিনি বলেন, ১৫% করে কালোটাকা সাদা করার বিপরীতে সৎ করদাতাদের সর্বোচ্চ ৩০% হারে কর দেয়ার বিধান বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক। এই পদক্ষেপ সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সরকারের আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা আজিজ আহমেদ এবং বেনজীর আহমেদদের মতো দুর্নীতিবাজদের কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ সৃষ্টির জন্যই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কিছু রাজস্ব আদায় হলেও এতে সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হবে। এটি স্পষ্ট যে- বাজেটটি এমন কতিপয় ব্যক্তির মুনাফার জন্য প্রণীত হয়েছে, যারা এই অবৈধ সরকারকে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সাহায্য করছে। এর কুফল শুধু আগামী বছর নয়, আগামী দশকেও জাতিকে বহন করতে হবে।
কল্পনার এক ফানুস: এই বাজেট কল্পনার এক ফানুস বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। বলেন, যে সরকার নিজেই আইন-কানুন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ডামি সংসদ বানিয়েছে, এমন সরকারের পক্ষে বাজেট প্রদানের কোনো নৈতিক অধিকার নেই। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। অথচ সেই জনগণই ভোট দিতে পারেনি। এ সরকার জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি অবৈধ সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য এ সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষদের শোষণের লক্ষ্যে একটি সাজানো হাতিয়ার মাত্র। বর্তমান লুটেরা সরকারের এ বাজেট কেবলমাত্র দেশের গুটিকয়েক অলিগার্কদের জন্য, যারা শুধু চুরিই করছে না, তারা ব্যবসা করছে, তারাই পলিসি প্রণয়ন করছে, আবার তারাই পুরো দেশ চালাচ্ছে। দেশ আজ দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এই বাজেট ফোকলা অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
বাজেট কর ও ঋণনির্ভর: প্রস্তাবিত বাজেট দেশি-বিদেশি ঋণ ও সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া করের নির্লজ্জ ফিরিস্তি ছাড়া আর কিছুই নয় বলে জানান ফখরুল। তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নের জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন, সেটাই এ অলিগার্করা লুট করে নিয়েছে। ব্যাংকগুলো খালি। সরকারের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে অলিগার্করা ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে শূন্য করে দিয়েছে। এ অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। তথাকথিত এই বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থ লাগবে সেটা সংকুলানেরও প্রস্তাব করা হয়েছে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে। এ বাজেট করনির্ভর, এ বাজেট ঋণনির্ভর, এ বাজেট লুটেরা-বান্ধব। অসহনীয় মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ জনগণের ত্রাহি অবস্থা, এর ওপর বাজেটে করের বোঝা। এই বাজেট একদিকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ধ্বংসপ্রায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং অন্যদিকে গণমানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর তামাশা মাত্র। জনগণের সঙ্গে করুণ হৃদয়বিদারক প্রতারণাই বটে।
চুরি হালাল করার ধান্দাবাজির বাজেট: বর্তমানে বাংলাদেশ লুটেরাদের কবলে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট নিজেদের চুরি হালাল করার ধান্দাবাজির বাজেট। এই বাজেটে দেশের অর্থ নতুনভাবে লুটপাটের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে অনেক বেশি। অথচ পুরো বোঝাটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের ওপরে। ঋণ ও ঘাটতিভিত্তিক বড় বাজেট অতীতে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, আগামীতেও হবে না। একটি অনির্বাচিত সরকারের ওপর করদাতারা আস্থা রাখে না। এ বছর আগের ১২ বিলিয়ন ডলারের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে। এই বাজেট আসলে শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটির মধ্যে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটিই ঘাটতি। অর্থাৎ বাজেটের এক তৃতীয়াশংই ঘাটতি যা মেটানোর প্রস্তাব করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ দেড় লাখ কোটি ও বৈদেশিক এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে। ঋণ দিয়ে ঋণ পরিশোধের ফন্দি।
তিনি আরও বলেন, এই বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এ বাজেটে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোনো আশা নেই। বাজেটে চাকরি হারানো এবং দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য কোনো পুনর্বাসন রোডম্যাপ নেই। বাজেট বক্তৃতায় সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো উন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলা হলেও, তার বাস্তবিক কোনো পথনির্দেশনাই নেই এই বাজেটে।
বাজেট বাংলাদেশ বিরোধী: এই বাজেট শুধু গণবিরোধী নয়, এ বাজেট বাংলাদেশ বিরোধী বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেন, পুরো বাজেটটিই করা হয়েছে মেগা-প্রকল্প ও মেগাচুরির জন্য, দুর্নীতি করার জন্য। অর্থনীতির এই ত্রিশঙ্কুল অবস্থায় উচিত ছিল অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পসমূহ বা অর্থহীন, অনুৎপাদক দৃশ্যমান অবকাঠামোগুলো বন্ধ রাখা। সেই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমুখী খাতে ব্যবহার করা যেতো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও সমপ্রসারিত করা যেত। কিন্তু সেগুলো বন্ধ করলে তো দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে! তাই বোধগম্য কারণেই সেটা করা হয়নি।
ফখরুল বলেন, এবার শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপি’র ১.৬৯%, যা চলতি বছরে ছিল ১.৭৬% এবং ২০২২-২৩ সনে ছিল ১.৮৩%, এবং ২০২১-২২ এ ছিল ২.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমান গণবিরোধী সরকার শিক্ষা খাতে ক্রমাগত বরাদ্দ কমাচ্ছে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রেখেছে জিডিপি’র ০.৭৪ শতাংশ, যা নিতান্তই অপ্রতুল। কৃষির জন্যও বরাদ্দ কমিয়েছে এই মাফিয়া সরকার। সরকার কৃষককে সহায়তা না করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লাখ কোটি টাকা ভর্তুকির অর্থ তুলে দিয়েছে বিদ্যুৎ সেক্টরের অলিগার্কদের হাতে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেই।
তিনি বলেন, এ বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৬.৫ শতাংশ। কিন্তু কীভাবে এ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে তার কোনো পথনির্দেশনা নেই। আর কে না জানে, সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু সিন্ডিকেটের কারণেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত বছরের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে। এ সকল সিন্ডিকেট কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, বাজেটে সে বিষয়ে কোনো আলোচনাই স্থান পায়নি। বাজেটে তাই সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বস্তি নেই।
অর্থনীতির বেলুন মূলত ছিদ্র হয়ে পড়েছে: তিনি বলেন, বিগত অর্থবছরে টাকার মান হিসাব করলে, ডলারের বিপরীতে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটে ৯৭% অর্থই আনতে হবে ভিক্ষা করে। তাহলে কি উন্নয়নের নামে বাংলাদেশ পুনরায় ৪০ বছর আগের সেই ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়লো? বাজেটের আকার কমে যাওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী প্রোপাগান্ডা সেল কর্তৃক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো অর্থনীতির বেলুন মূলত ছিদ্র হয়ে পড়েছে। এদিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬.৭৫% প্রস্তাব করা হলেও বাস্তবে তা অর্জন সম্ভব হবে না। বিশ্বব্যাংক বলছে প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৬ শতাংশ। বাজেটের প্রায় ৪ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকার দুই-তৃতীয়াংশই যাবে অনুৎপাদনশীল বেতন, প্রণোদনা, ভাতা ও ভর্তুকি খাতে। উৎপাদন না হলে প্রবৃদ্ধি হবে কোথা থেকে।
বাজেটে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম: মির্জা ফখরুল বলেন, প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা এবং রাজস্ব লক্ষ্য ধরা হয়েছে অনুদানসহ ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক কম।
তিনি আরও বলেন, গত বছর ঋণের বোঝা ছিল মাথাপিছু ১ লাখ টাকা, যা গত এক বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিটি নবজাতক শিশুকে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্ম নিতে হবে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিই আজ ঋণময়। মেগা প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফিজিবিলিটিবিহীন এসব ঋণ আমাদের সমগ্র অর্থনীতিকে দেশি-বিদেশি অলিগার্কদের কাছে জিম্মি করে ফেলছে। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি কার্যত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে ডলার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলো রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠার কোনো রোডম্যাপই এই বাজেটে দেয়া হয়নি। অথচ রিজার্ভ ও ডলার সংকট বর্তমান অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সংকট।
গতানুগতিক বাজেট: ফখরুল আরও বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত ধনী ও গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বাজেটে পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো, আয় ও সম্পদের বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। আর অর্থ পাচার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে ছয় বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সিংহভাগই সরকার ও ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট। আর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে যে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, এতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। মুদ্রা বাজারে বড় প্রভাব পড়বে। এমনিতে নেতিয়ে থাকা এসব ব্যাংক থেকে সরকারই যদি এত বিশাল অঙ্কের ঋণ নেয় তাহলে তারল্য সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে। আমানতকারীদের সর্বনাশ হবে। এমনিতেই কয়েক কোটি বেকার। তার ওপর বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব আরও প্রকট হবে। সামনে অন্ধকার। চলমান চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক এই বাজেট কোনো সমাধান দিতে পারবে না।