সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জোনাক পোকাদের মনে আনন্দের সীমা নেই। খুশিতে ঘুম নামে না রঙিন প্রজাপতির চোখে। বনের পশুপাখির কানে কানে কে যেন জানিয়ে দিল তিনি আসছেন। আসছেন দয়ালু নবী (সা.)। পেয়ারা নবীর সিরাত নিয়ে যাঁরাই কলম ধরেছেন তারাই বলতে বাধ্য হয়েছেন, রসুল (সা.) যেদিন ধূলির ধরায় তাশরিফ এনেছেন সেদিন মরু আরবের প্রতিটি ধূলিকণাও খুশিতে বাগ বাগ হয়েছিল। সিরাতের বিখ্যাত কিতাব মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থের লেখক বলেন, রসুল (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন সে রাতের মর্যাদা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে সে রাতে যে লক্ষণগুলো ইতিহাসবিদরা বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা থেকে এটাই প্রমাণ হয়, এমন মর্যাদাপূর্ণ রাত পৃথিবীতে আসেনি আর আসবেও না। মাওয়াহেবের লেখক বিখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম কুস্তালানি (মৃত্যু ৯২৩ হিজরি) রসুলের জন্ম তারিখ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বলেন, সবচেয়ে বিশুদ্ধতম মত হলো, রসুল (সা.) মক্কায় হস্তীবাহিনীর আক্রমণের ৪০ মতান্তরে ৫০ দিন পরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধমতে, হুজুরের জন্মের তারিখ ছিল ১২ রবিউল আউয়াল। এ তারিখেই মক্কাবাসী রসুল (সা.)-এর জন্ম উপলক্ষে বিভিন্ন নফল ইবাদত করত। হুব্বে রসুলের আলোচনার আসর বসাত। (মাওয়াহেব, প্রথম খন্ড, ২৫ পৃষ্ঠা; ইবনে হিশাম প্রথম খন্ড ১৬৪ পৃষ্ঠা)।
ভারতবর্ষের প্রখ্যাত মুহাদ্দেস আবদুল হক দেহলভি (রহ.) তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘মা ছাবাতা মিনাস সুন্নাহ’য় রসুলের (সা.) শুভাগমন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি সুন্নাহ থেকে প্রমাণ করেন, কুল কায়েনাতের সর্দার রসুলের জন্মের রাতের মর্যাদা অন্য সব মর্যাদাপূর্ণ রাতের চেয়ে অনেক বেশি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই রসুলের জন্মের রাতটির মর্যাদা লাইলাতুল কদরের চেয়ে বেশি। আমাদের যুক্তি হলো, লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল হয়েছে আর রসুলের জন্মের রাতে স্বয়ং হুজুর (সা.) দুনিয়ায় তাশরিফ এনেছেন। লাইলাতুল কদর সম্মানিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এ রাতে ফেরেশতাকুল দুনিয়ায় নাজিল হয়। আর রসুলের জন্মের রাতে কুলকায়েনাতের রহমত হাবিবে খোদা দুনিয়ায় এসেছেন। সুতরাং ফেরেশতাদের আগমনের চেয়ে নবীজির আগমনের রাত বেশি ফজিলতপূর্ণ হবে এটাই যুক্তির দাবি।’ (মাওলানা নুরুল হক, নূরে মুজাসসাম মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ)। প্রিয় নবীজির শুভাগমনের খবর শুনে তাঁর চাচা আবু লাহাব খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি এতই খুশি হয়েছিলেন যে, তাঁর দাসী সুয়াইবাকে দুই আঙুলের ইশরায় আজাদ করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সহি বর্ণনায় এসেছে, আবু লাহাবের মৃত্যুর পর কোনো এক ব্যক্তি মতান্তরে তাঁর ভাই আব্বাস তাঁকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার হায়াতে বরজখ কেমন যাচ্ছে? আবুল লাহাব বললেন, হে আমার ভাই! জাহান্নামে খুব কষ্টে আছি। তবে প্রতি সোমবার আমার আজাব কিছুটা হালকা করা হয়। কেননা আমার ভাতিজা মুহাম্মদ সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছে আর এ কারণে আমি খুশি হয়ে আমার দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম। আমি তাকে দুই আঙুলের ইশারায় মুক্ত করেছিলাম। তাই সোমবার এলেই আমার দুই আঙুলের ডগায় সুস্বাদু পানি চলে আসে। আমি আঙুল চুষে এক সপ্তাহের তৃষ্ণা মেটাই।’ রসুল (সা.) আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তাঁর জন্ম ও আবির্ভাব যেমন আমাদের জন্য রহমত, একইভাবে তাঁর জীবনাদর্শও আমাদের জন্য অনুকরণীয়। রবিউল আউয়াল মাস এলে নবীজীবনী চর্চা বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নবীপ্রেম চর্চার জন্য কোনো মাস বা দিন নির্ধারিত আছে এমনটি নয়। বরং জীবনের প্রতিটি বাঁকেই রসুল (সা.)-কে অনুসরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিদায় হজের ভাষণে রসুল (সা.) একাধিকবার বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কোরআন আর আমার আদর্শ রেখে যাচ্ছি।’
এ দুটি আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। হায়! রবিউল আউয়াল মাস আসে যায়, কিন্তু উম্মতের মাঝে নবী আদর্শের চর্চা তেমন একটা দেখা যায় না। আজ আমাদের লেবাস, সুরত, চিন্তা-চেতনা সব জায়গায়ই নবীর আদর্শ অনুপস্থিত। নবীজি বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না, ঝগড়া কোরো না। অথচ আমরা ধর্ম নিয়েই ফেতনায় জড়াই বেশি। আমরা সহজ-স্বাভাবিক আল্লাহওয়ালা জিন্দেগি ভুলে লোভ-হিংসার গান্দেগির জীবনে ডুবে আছি।