আমরা যারা ৯০ এর দশকের তারা টিভিতে নাটকে দেখতাম বড়রা কথা বললে ছোটদের অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিত,রাস্তায় সিগারেট খাওয়ার সময় মুরুব্বি কাউকে দেখলে সিগারেট লুকিয়ে ফেলত হয়তো সেই মুরুব্বিও সিগারেট খেতেন কিন্ত এটা হলো সভ্য মানুষ হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেয়ার একটা বিষয়।বাসায় ভালো কিছু যেমন,মাছ-মাংস রান্না হলে মা-চাচীরা, মাছের মাথাটা সবসময় বাবা অথবা ঘরের প্রধান তার জন্য তুলে রাখতেন। তিনি যে এই পরিবারের প্রথম শ্রেণীর মানুষ,তাকে সম্মান করা তার সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা হতো না।
ঘরের প্রধানের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেও, তার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস কখনই তৈরি হয়নি।
আবার দাদা-দাদী নানা-নানি এবং পরিবারের বড়দের সম্পর্কে মা অথবা বড় বোন বুঝিয়ে দিতেন যে, সিনিয়ররা জুনিয়রদের চেয়ে অধিক শ্রদ্ধাভাজন এবং অধিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন।বাসায় সার্বক্ষণিক মায়ের সাহায্যকারী মানুষ থাকলেও খুব অল্প বয়েস থেকেই নিজের কাপড়, পড়ার টেবিল খাওয়ার পর নিজের প্লেট ধুয়ে রাখা, এবং ঘরের একদম কনিষ্ঠ বাচ্চাটিকে দেখে রাখা শিখে নিতাম।এই ব্যাপারগুলা থেকেই কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়ীত্ববোধ কখন যে হয়ে গেছে তা টের পাওয়া যেতো না, বাসায় সাহায্যকারী থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি কাজ নিজেকেই করতে হতো।
এখন অবস্থা,সময় দিন পাল্টেছে।আসলেই কি বদলেছে সময়!!
না! সময়, দিন ঠিকই আছে বদলেছি আমরা, আমাদের কৃতকর্ম আমাদের আজকে একটা অসুস্থ পরিবেশে নিপতিত করেছে।বর্তমান সময়ের পিতা-মাতাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কে? তারা এক বাক্যে বলবে তাদের সন্তান। তাদের সন্তান খুবই মুল্যবান,সোনার টুকরা, হীরার টুকরা, প্লাটিনামের টুকরা ইত্যাদি। ভাবখানা এমন যে পরিবার মানেই বাবা-মা(কম গুরুত্বপূর্ণ) সন্তান নিয়েই জগৎ। অথচ হওয়ার কথা ছিল সবাই মিলে পরিবার তথা পৃথিবী।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন বাচ্চাদের এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলছেন! তারা এমন কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে যে তাদের এত প্রায়োরিটি দিচ্ছেন?কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারবেনা।এইভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্যভাবে না গড়ে তুলে এবং কোনো যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই পরিবারের প্রথম শ্রেণীর সদস্য বানিয়ে আসলে নিজেদের ক্ষতি,পরিবার এবং সমাজের ক্ষতি করা হলো। এই বিশাল ক্ষতির প্রতিফলনই দেখছি আজকে সমাজে।একটা অফিসে যদি সিনিয়রের পরিবর্তে জুনিয়র বেশি গুরুত্ব পায়, তাহলে ঐ অফিসের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।কথায় আছে ” বারো গাড়ি আর্মি আর তেরো গাড়ি মেজর ” মানে আর্মি জেনারেলের চেয়ে তার অধীনস্থ সৈন্যরা বেশি গুরুত্ব পায়,তাহলে ঐ আর্মি দিয়ে যুদ্ধ হেরে যাওয়াই স্বাভাবিক।
একজন সন্তান শুধু তার পিতা-মাতার না,সে পুরা সমাজের,সমস্ত সমাজ মিলেই তাকে বড় করে তার ভাষা, গালি,বিবেচনা, বোধ এবং নানা বিধ আচরণ সে সমাজ থেকে নিজের অজান্তেই শিখে নেয়।আমাদের সন্তানরা যদি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারে, তারা পরিবারের প্রথম শ্রেণীর সদস্য, তাদের সুযোগ সুবিধা দেখার জন্যই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বাবা-মাকে,এবং চাওয়া মাত্রই তাদের প্রয়োজন মেটানো হবে এবং পরিবারের আরো সিনিয়র শ্রেণির সদস্য দ্বিতীয় শ্রেণির এবং তাদের দাদা-দাদী,নানা-নানি হলো তৃতীয় শ্রেণির সদস্য সাথে সমাজের অন্যান্য মানুষকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না ভাবা তাহলে সেই সন্তানের কাছ থেকে এই সমাজ তথা পৃথিবীর পাওয়ার কিছু নেই একদম।
সন্তান যখন দেখবে, সে কোন যোগ্যতা অর্জন ছাড়াই এই পরিবারের প্রথম শ্রেণীর সদস্য, তখন সে এমনকি যোগ্যতা অর্জন করতেও চাইবে না,তার মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক স্বভাব প্রকট ভাবে দেখা দিবে।সে পরিবার ও সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করে নিজেকে যোগ্য মানুষ করতে হয় সেটা শিখবেনা।
এখন মাঝে মাঝেই শোনা যায়, সন্তান মা-বাবার সঙ্গে জেদ করছে,হাই স্কুল পার না হতেই দামী হোন্ডা, দামী মোবাইল ফোন কিনে দেওয়া বা দামী ল্যাপটপ কিনে দেওয়া হচ্ছে না কেন!এইসব জিনিস না পেলে অনেক সময় আত্মহত্যার মত দূর্ঘটনা ঘটায়।
কিন্ত একটু ভাবলেই দেখবো তারা কেনো এরকম করছে,কারন এটাই স্বাভাবিক, তারা জেনে বড় হয় যে তাদের সুবিধা দেওয়াই তাদের বাবা-মার দায়িত্ব। তারা কিভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে এটা তাদের ব্যাপার। বাবা-মা এখন আর চায় না যে তাদের সন্তান একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হোক। বাবা-মা তাদের সন্তানদের তাদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে কখনই জানান না, সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে কখনো কিছু বলেন না।সন্তানকে বলে তোমাকে,বিসিএস ক্যাডার,ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হতে হবে।
কতজন বাবা-মা আছে যে তাদের সন্তানদের বলে, “তোমরা ভালো মানুষ হও?
পারিবারিক দায়িত্ববোধহীন, সামাজিক সম্পর্কহীন এইসব ছেলেমেয়েরা পরিবার এবং সমাজকে কিভাবে শিক্ষা সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল করবে!এরা বরং যে কোন সময় সুবিধাজনক প্লাটফর্মে নিজেদেরকে নিয়ে অহংকার করবে। কোনটা লজ্জাবোধের বিষয়, কোনটা অহংকারের বিষয় – পার্থক্য তৈরি করতে পারবে না তারা।
বাবা-মার প্রাথমিক দায়িত্ব সন্তানকে একজন সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নৈতিক,সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা শুধু বড় চাকুরীজীবি বা ব্যবসায়ী বানানো নয়।একজন সন্তানকে দায়িত্বশীল, বিবেকবান, সহানুভূতিশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা প্রতিটি বাবা-মা এবং সমাজের সবার দায়িত্ব।