• শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ০১:৪৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম
বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের সংঘর্ষ : রাত দেড়টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ নুর দুইবার হজের ফ্লাইট মিস করা সেই আমের গাদ্দাফির মৃত্যু খবর ভাইরাল ভারতে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তারেক রহমানের শোক অধ্যাপক ইউনূসের কিংস তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ ভারতে বিমান দুর্ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার শোক প্রকাশ, সব ধরনের সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ ঢোলারহাট ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে নেই স্কুল, দূরে যেতে অনীহা কোমলমতি শিশুদের লক্ষ্মীপুরে ইমাম মিলন হত্যায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে জাতীয় ইমাম সমিতির সংবাদ সম্মেলন ডিমলা থানায় ধর্ষণের চেষ্টা মামলার অভিযোগ না নেওয়ায় ভুক্তভোগীর সংবাদ সম্মেলন  সাতকানিয়ায় বালু ব্যবসায়ীকে অপহরণের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার কোরবানির পর হজমশক্তি বাড়াতে যেসব খাবার খাবেন

বায়ান্ন’র বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা অলি আহাদ: আজকের বাংলাদেশ ও কিছু স্মৃতি

একুশে সংবাদ ডেক্স / ১১৮ Time View
Update : রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

 

লেখক : মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত

বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, আপোষহীন জননায়ক, ইত্তেহাদ সম্পাদক অলি আহাদ। দীর্ঘ ৪ যুগ রাজনৈতিক ও সাংবাদিক হিসেবে গভীরভাবে সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর সম্পর্কে কিছু না লিখলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আজকাল এ ধরণের নির্লোভ, নিঃস্বার্থ নেতাদের সম্পর্কে কেউ খুব একটা লিখতে চান না।
নিঃশঙ্কভাবে, দ্বিধা ছাড়া শুরুতেই প্রকাশ করতে হয় যে আমার এই লেখা এমন এক ভগ্নহৃদয়, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও আক্ষেপ সর্বস্ব ব্যক্তির বিলাপ, যার এখন কষ্ট সহ্য করার মত মানসিক ও শারীরিক অবস্থা অবশিষ্ট নেই।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, জাতীয় নেতা অলি আহাদ সম্পর্কে কিছু কথা লিখতে হয়। অলি আহাদ ছিলেন আমার নেতা ও আমি যে পত্রিকা ইত্তেহাদ-এ রিপোর্টার ও স্পেশাল করস্পন্টেড হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি সেই পত্রিকার সম্পাদক। ইত্তেহাদ-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। অলি আহাদ সাহেবের সাথে সংগঠনও করেছি। তিনি যে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আমাকে সেই সংগঠনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত করেছিলেন। অলি আহাদ ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।
নেতা অলি আহাদের সংস্পর্শে থাকার কারণেই ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য নেতা ও সংগঠক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, গাজীউল হক, আবদুল মতিন, কে.জি মুস্তফা, এম.আর আখতার মুকুল, শামসুদোহা (নারায়নগঞ্জ), চট্টগ্রামের মাহবুবুল আলম চৌধুরী (তিনি আমাদের অগ্রজ প্রতীম আত্মীয়), অধ্যাপক আবদুল গফুর সহ অনেকের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছে।
নেতা অলি আহাদ বলতেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আবেদনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনতার রুদ্ররোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। গণ-অভ্যূত্থানের এক উত্তাল ঢেউ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনপদ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্লাবিত করে। এই আন্দোলনের মর্মমূলে জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবী সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্র এই সেøাগান হতেই স্পষ্টতর হয় যে, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। উর্দু ভাষার প্রতি কোন বিদ্বেষ ছিল না বলেই ‘উর্দু-বাংলা ভাই ভাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেই সেøাগানও সেদিন উচ্চারিত হয়েছে। সকল প্রকার সংকীর্ণতামুক্ত ছিল বলেই আন্তর্জাতিক কাজ-কর্মে ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল।
পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী শাসকদের স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সমুদ্র গর্জন শোনা গিয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। এটা কোন আকস্মিক আবেগ বা উত্তেজনার ফসল ছিল না। অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিকারের জন্য বিরোধী দল হিসেবে ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তথা সমগ্র পাকিস্তানে বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। বৃহত্তর চট্টগ্রামে দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আমার বাবা মরহুম আবদুল লতিফ উকিল ও সাধারণ সম্পাদক এম.এ. আজিজ। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক উপ নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও নানা অজুহাতে শাসক শ্রেণী তাঁকে পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে দেয়নি। এই প্রতিবাদী শক্তির ইতিহাসকে বুঝতে হলে আরো পেছনে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশের মানুষের উদার মানবতাবাদ অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও লড়াইয়ে পরাধীনতার বেদনা এবং স্বাধীনতার আকুতি শিল্প-সাহিত্যে প্রকাশ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ। সাহিত্য অঙ্গনে যে মুক্তবাণী জ্বলে উঠেছিল, তারই অগ্নিগর্ভ প্রকাশ ঘটেছিল মধ্যযুগের প্রদোৎ আলোয় এবং আধুনিক যুগের ঊষালগ্নে তিতুমীর- শরীয়তুল্লাহ’র সাম্য ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিঃশেষে প্রাণদানের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ফরাসী বিপ্লবের ভাবধারায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, পর শাসনের গ্লানির বিরুদ্ধে, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মদান সেই রক্ত পিচ্ছিল পথেই এসেছিল। তারই উজ্জ্বল উত্তরাধিকার নিয়ে বরকত, জব্বার, সালাম, রফিক, শফিক এ দেশের বুকে নতুন ইতিহাসের সূচনা করেছিল। রক্তে রক্তে আঁকা এই প্রচ্ছদপট কালক্রমে জাতীয় স্বাধীনতার গৌরবময় অধ্যায় সূচনা করেছিল।
এদেশের ইতিহাস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাহসিক লড়াইয়ের। সংগ্রামীদের পথ নির্দেশের ধ্রুবতারা হিসেবে মহান একুশ ফেব্রুয়ারি দুর্যোগের দিনে জাতিকে পথ দেখিয়েছে, নির্ভীক-নিঃশঙ্কচিত্তে মাথা তুলে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছে বারবার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বহু আন্দোলনে অস্তিত্বের সারথী হয়ে একুশ ফেব্রুয়ারির অন্তর্নিহিত শক্তি জাতিকে চালিত করেছে। গণতন্ত্র আজ চক্রান্তের বিষ নিঃশ্বাসে নির্জীব। জাতীয় অর্থনীতি আরও তীব্র হয়েছে লুঠপাঠ ও লুঠেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার কারণে। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ক্ষমতার দ্বন্দ এবং প্রবলের মুষ্ঠিপীড়নে বলহীন করা হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাস হতে শিক্ষা লাভ করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। গণতন্ত্রহীন পরিবেশে দেশ শাসন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার কারণে দুঃখজনকভাবে আমাদের বহু মূল্য দিতে হয়েছে। জাতি কি অতীত অভিজ্ঞতা হতে শিক্ষা লাভ করবে না? এ প্রশ্নের জবাব শহীদদের রক্তস্নাত একুশের স্মরণীয় দিনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেই জাতি দিতে পারে। শুধু আবেগ সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা আত্মপ্রবঞ্চনাকে স্ফীত করবে, জাতিকে বিভ্রান্তির পথে নিমজ্জিত করবে।
জাতীয় জীবনে এই সংকট দেখা দিয়েছে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ততবিধ সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী, ক্ষমতার প্রতি উদগ্র মোহ, আত্মস্বার্থ উদ্ধার, জনতার মুখের গ্রাস কেড়ে বিলাসের গ্রোতে গা ঢেলে দেবার মানসিকতা হতে। জীবনকে যদৃচ্ছ উপভোগের দৃষ্টিভঙ্গী সমাজের স্তরে স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। সরকার যে এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক তা বিভিন্নভাবে তদন্তে উঠে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মধ্যে আত্মকলহও রয়েছে দুর্নীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দুর্নীতির মুলোচ্ছেদ হবে না। দুর্নীতির রাজনীতিতে কারা কতখানি দক্ষ তা প্রমাণিত। দুর্নীতি, অপচয় ও আমলাতান্ত্রিক গদাই লস্করী চাল দেশের সার্বিক সংকটের জন্য দায়ী। সরকারী নীতি, প্রবঞ্চনামূলক প্রচারধর্মিতা প্রকৃত অবস্থা গোপন করে দেশকে এক ভয়াবহ সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী’র বছরে একুশ ফেব্রুয়ারির দিনটিকে শুধু জাতীয় আশা-আকাঙ্খার স্মারক হিসেবেই দেখব না, যে অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সেদিন তরুণরা রাজপথে রক্ত দিয়েছে, জাতীয় মুক্তির সেই সঠিক লক্ষ্য হতে আমরা ভ্রষ্ট হব না- এই শপথই করব এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণতন্ত্রের পতাকা- যা ইতিমধ্যে শাসকের ক্ষমতার দর্পের হাতে প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত হচ্ছে, তা বহন করার দায়িত্ব জাতিকে আজ গ্রহণ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে- একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন শাশ্বত। এই আবেদন বিদ্রোহের, বিপ্লবের। যুগে যুগে এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের আবেদনই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাতিকে উজ্জীবিত করবে। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা অলি আহাদ সম্পর্কে লিখতে গেলে অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়। বলতে বলতে লিখতে গেলে অনেককিছুই ভুলে যাই। দীর্ঘ চার দশক গভীর সম্পর্ক ও তাঁর সাথে সাংগঠনিক ও বিভিন্নভাবে জড়িত থাকায় অনেক অনেক স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসে। এক কথায় বলা যায়- তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, কিংবদন্তী ও সৎ রাজনীতিবিদি, রাজনীতির শিক্ষক, অভিভাবক। দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে ভালবাসতেন গভীরভাবে।
দু’একটি ঘটনার কথা না লিখে পারছি না। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের সময়ে নেতা অলি আহাদকে কারারুদ্ধ করে বিশেষ সামরিক আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সরকার মামলা দেয়। এই আদালতে অলি আহাদ সাহেব একটি জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীটি দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠানো হয়। দৈনিক ইত্তেফাক দু’লাইনের একটি রিপোর্ট করে, কিন্তু জবানবন্দীটি ছাপাতে পারেনি। দেশের অন্যকোনো পত্রিকাও এটি ছাপায়নি। তখন আমার সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে ইজতিহাদ প্রকাশ হচ্ছিল। আমি ঢাকায় অলি আহাদ সাহেবের সহধর্মিণী ম্যাডাম অধ্যাপিকা রাশিদা বেগমকে টেলিফোন করে সামরিক আদালতে দেয়া জবানবন্দীর কপি আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি জানান তাঁর কাছে তা নেই- অধ্যাপক মোমেনুল হক সাহেবের কাছে থাকবে। জবানবন্দী কেনো দরকার তা ম্যাডাম রাশিদা বেগম জানতে চাইলে আমি বললাম, এটি ইজতিহাদ-এ পুরোটাই ছাপাব। তখন তিনি বললেন এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ হবে। পত্রিকা নিষিদ্ধ হবে আর আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে। উনার এই সহানুভূতির জন্য আমি কৃতজ্ঞ হয়ে আছি। যা হোক এরপর ঐ জবানন্দী সংগ্রহ করি এবং পুরোটা ইজতিহাদ-এ ছাপাই। তিন দিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ বলে (আদেশ নং- ৭৫৬,এইচ এ, রাজনৈতিক-৩, তারিখ: ০৬-১১-১৯৮৪) ইজতিহাদ-এর প্রকাশনা সরকার নিষিদ্ধ করে এবং আমার উপর চলে হয়রানি। জেল থেকে বের হবার পর অলি আহাদ সাহেব আমার খোঁজ নেন। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় উনার সাথে দেখা করতে গেলে পুরোনো পল্টনের অফিসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন।
আমার নেতা অলি আহাদকে নিয়ে অনেক অনেক স্মৃতি। পরবর্তীতে কোনো সময় সুযোগ পেলে লিখব। উনাকে নিয়ে মুন্সী আবদুল মজিদ (মরহুম) ‘চিরবিদ্রোহী অলি আহাদ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন ২০০২ সালে। বইটির ২০৩ পৃষ্ঠায় আমাদের একটি অনুষ্ঠানের ছবিও ছাপা হয়েছিল।
১৯৯৩ সালের নভেম্বরের কোন একদিন আমি পুরোনো পল্টন অলি আহাদ সাহেবর অফিসে বসা। সেদিন পত্রিকায় ঘোষণা আসল ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রত্যক্ষ ভোটে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অলি আহাদ সাহেব পত্রিকা পড়ে বললেন ‘তোমাকে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন করতে হবে ৬ দলের সমর্থন নিয়ে’। আমি নুরুল আবছার চৌধুরী’র কথা বললে তিনি বললেন, আবছার সাহেব সংসদ নির্বাচন করেছেন। তুমি মেয়র নির্বাচন করবে। উনার আহ্বানে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সম্মতি দিয়ে বললাম, নির্বাচনে জিততে পারবো না। তিনি বললেন, নির্বাচনে সবাই জেতে না। কেউ শিখতে, কেউ শেখাতে নির্বাচন করে। মেয়র নির্বাচনে যে ৬ দল আমাকে সমর্থন দিয়েছিল সেই দলগুলো ছিল অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক লীগ, আজিজুল হক শাহজাহানের নেতৃত্বাধীন কেএসপি, ম. নূরনবীর নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল, আবদুল মতিন মাস্টারের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ (ভাসানী), এডভোকেট গরীব নেওয়াজের নেতৃত্বাধীন পিপলস্ লীগ ও সিরাজুল হক গোরা’র নেতৃত্বাধীন মুসলিম জাতীয়তাবাদী দল। নির্বাচনী প্রচারণায় নেতা অলি আহাদ চট্টগ্রামে এসেছিলেন এবং কয়েকটি সভা-সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর সাথে নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দিয়েছিলেন জয়যাত্রা সম্পাদক আহমদ মীর্জা খবীর, সাংবাদিক মোহাম্মদ মোসলেম খান, ডাঃ কাজী মোহাম্মদ ইউসুফ, সাংবাদিক এস.এম. জামালউদ্দিন, সাংবাদিক আবু মোহাম্মদ শাহীন, সাংবাদিক ওসমান গণি। ঢাকা থেকে ৯০ এর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা সাইফুদ্দিন আহমদ মনি, সালাউদ্দিন তরুণসহ একঝাঁক যুব ও ছাত্রনেতা নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।
জাতীয় নেতা অলি আহাদ ইত্তেহাদ সম্পাদক হিসেবে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণেও সাহসী ও যুক্তিপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৮০ সালে ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকা-ের পর আমার একটি রিপোর্টসহ কয়েকটি রিপোর্ট ও ভিউস এর কারণে সরকার ইত্তেহাদ এর উপর প্রি সেন্সরসীপ আরোপ করে। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। প্রি সেন্সরসীপ প্রত্যাহারে প্রতিকার চেয়ে ইত্তেহাদ সম্পাদক অলি আহাদ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে একটি মামলা (নং- এফ/২,১৯৮১) দায়ের করেন। তখন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন গাজী শামসুর রহমান। মামলাটি আমলে নিয়ে প্রেস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংশ্লিষ্টদের কাছে ইত্তেহাদ এর উপর কেন প্রি- সেন্সরসীপ আরোপ করা হয়েছে- তা জানতে চেয়ে নোটিশ দেয়া হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রি-সেন্সরসীপ প্রত্যাহার করে একটি আদেশ দেন, অন্যকোনো ঝামেলা না করে। অলি আহাদের এই মামলা বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ও দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণের ইতিহাসে স্মরণীয় ও নজির সৃষ্টিকারী।
অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। ঐ বইতে তিনি তাঁর সুদীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক ঘটনারাজী সময়ানুক্রমিকভাবে তুলে ধরেছেন। রাজনীতিতে অলি আহাদ বেছে নিয়েছিলেন বিবেক নির্দেশিত কণ্টাকাকীর্ণ পথ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সরকারই তাঁকে মন্ত্রীত্বের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, নূরুল আমিন, আইয়ুব খান, ইযাহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ পর্যন্ত প্রায় সবসরকারের আমলে তিনি কারারুদ্ধ হয়েছেন। তিনি ১৭ বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। শুধু এরশাদ আমলেই তিনি ছয়বার কারারুদ্ধ হন।
ইত্তেহাদ সম্পাদক, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, রাজনীতিবিদ, জাতীয় নেতা অলি আহাদকে দেয়া ১৯৭৯ সালের ৩০ শে জুলাই চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এই সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তখন সম্ভবতঃ রমজান মাস ছিল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইত্তেহাদ সম্পাদক অলি আহাদ সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কথা বলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ পত্রিকাসহ দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ও ইত্তেহাদের বিশেষ প্রতিনিধি মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত। অনুষ্ঠানে জাতির প্রতি অলি আহাদের অবদানের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রাক্তন সভাপতি সায়ফুল আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নুর সাঈদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি ইমামুল ইসলাম লতিফি, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সৈয়দ মোস্তফা জামাল, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ফারুকী, আয়োজক সংগঠনের সহ-সভাপতি মুহাম্মদ ইব্রাহীম (পরবর্তীতে হাই কোর্টের অ্যাডভোকেট)। অলি আহাদের সম্মানে মানপত্র পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও খবর এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি এ.কে.এম কমরুল ইসলাম চৌধুরী এবং পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন কবি এস.এম. লুৎফুর রহমান। অনুষ্ঠান শেষে সকলের জন্য ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়।
* সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দানের সময় সংবর্ধিত অলি আহাদ বলেন, ‘গত ৩০ বছর ধরে এদেশে যে রাজনীতি চলে এসেছে তাতে শুধু ক্ষমতার লড়াই প্রাধান্য পেয়েছে- জনগণ বার বারই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রবাদী কোন সরকারই গণতন্ত্র কায়েম করতে পারে না। গত ৩০ বছর ধরে এ ধরণের রাজনীতিই এদেশে চালু রয়েছে যাতে জনগণের কল্যাণের বীজ নিহিত ছিল না। সাবেক পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সরকার কখনও আমেরিকা এবং কোন সময় অন্য বৃহৎ শক্তির হাতের পুতুল হয়ে দেশ শাসন করেছে। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরে ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি সম্পাদন করে আমাদেরকে দিল্লীর দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য করেছিল”। তিনি বলেন, “১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর পিন্ডির দাসত্ব শৃঙ্খল ভেঙে যখন নতুন করে দিল্লীর কাছে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেবার অশুভ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তখনই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এবং জনতার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে আমি সংবাদপত্র জগতে আসি”।
অলি আহাদ বলেন, “১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারি তদানিন্তন সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি বহুদলীয় গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিয়ে জাতির উপর চাপিয়ে দেয় একদলীয় শাসন, ১৬ই জুন এক নিষেধাজ্ঞা আইনের মারফত সমস্ত সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে কেবল ৪টি সংবাদপত্র সরকারি মালিকানাধীন রেখে বাকী সংবাদপত্রকে বাতিল ঘোষণা করে। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে জাতি মুক্তি চেয়েছিল”।
অলি আহাদ তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে ইত্তেহাদ পত্রিকার সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন “অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফসল হল ইত্তেহাদ এবং মুক্ত চিন্তা ও মুক্ত সমাজের স্পষ্ট ধারণায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বাসী ইত্তেহাদ তাই গণমানুষের কথা বলে”। তিনি দুঃখ করে বলেন, “নেতাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অব মরেলিটি (Double Standard of Morality) দেশের রাজনীতিকে বিষায়িত করে ফেলেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে নেতারা মুক্ত সমাজ ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তারাই সবকিছু ভুলে কণ্ঠরোধের যাবতীয় বিধি প্রণয়ন করে। অতীতে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তের ফলে বারবার রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল যা দেশের জন্য কল্যাণকর হয়নি। নেতাদের Double Standard of Morality দেশের রাজনৈতিক শূন্যতার জন্য দায়ী। পরিণতি হয়েছে একনায়ক শাসন”। তিনি বলেন, “আমরা উন্মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করি। বদ্ধ সমাজে মনমানসিকতার উৎকর্ষ সাধন হয় না বরং নতুন চিন্তাধারার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।… আমরা আইনের শাসন চাই এবং আইনের শাসনের রক্ষা কবচ হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। আমরা উন্মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধপরিকর। উন্মুক্ত সমাজেই মুক্ত বুদ্ধির স্বচ্ছন্দ বিকাশ ঘটে”। অলি আহাদ বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাতে দু’ধরণের এক নায়কতন্ত্র দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও জননেতারাই একনায়ক সাজছে। কোথাও কোথাও সেনানায়করাই এই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা মুক্ত বুদ্ধির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে বদ্ধপরিকর। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ইত্তেহাদ দ্ব্যর্থহীনভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে”।
অলি আহাদ ১৯২৮ সালে অবিভক্ত কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আবদুল ওয়াহাব ছিলেন ডিস্ট্রিক রেজিস্ট্রার। ভাইরাও ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদ। বোনদের বিয়ে হয়েছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেদের সাথে। তাঁর স্ত্রী অধ্যাপিকা রাশিদা বেগম বাংলাদেশের শিক্ষা অধিদফতরের প্রথম মহিলা মহাপরিচালক ও ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, একমাত্র সন্তান-কন্যা ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, অলি আহাদ নির্দেশিত সংক্ষিপ্ত মর্মকথা ও তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা লিখে নিজকে কিছুটা দায়মুক্ত করার এ প্রয়াস।
অলি আহাদসহ ভাষা আন্দোলনের সকল নেতা, সৈনিক যারা পরলোক গমন করেছেন তাদের এবং সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আসুন আমরা সকলে আরেকবার ঐক্যবদ্ধ হই- লাঞ্চিত গণতন্ত্রের পতাকা তুলে ধরতে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে।

লেখক পরিচিত :
মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত, ভাষা আন্দোলনের নেতা অলি আহাদের দীর্ঘ ৪ যুগের রাজনৈতিক সহকর্মী, সাংবাদিক- মুক্তিযোদ্ধা, ইজতিহাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বিশ্ব প্রেস কাউন্সিল নির্বাহী পরিষদ ও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সাবেক সদস্য।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

ফেসবুকে আমরা