২৪ মে ২০২৫, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের একটি অনির্ধারিত বৈঠকের পর যে-বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ও অগ্রাধিকারের বিষয়ে একটি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। এই বিবৃতিতে তিনটি মূল লক্ষ্য—নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার—কে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ত্রি-লক্ষ্য নিয়ে যদি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়, তাহলে তা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল করবে।
তবে এই মুহূর্তে বাস্তবচিত্র কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। অগ্রগতি কোথায়? অগ্রাধিকার নির্ধারণ কতোটা স্পষ্ট? রাজনৈতিক আস্থার যে-সংকট দিন-দিন ঘনীভূত হচ্ছে, তা নিরসনে সরকার কীভাবে জনগণ ও অংশীজনদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে—এই প্রশ্নগুলো এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আজ পর্যন্ত একটি জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়নি।
সরকার আগে বলেছে—ছোট সংস্কার ও বড় সংস্কারের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারিত হবে। এই বিভাজনের মানদণ্ড কী? তা স্পষ্ট করা জরুরি। সংবিধান সংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলো ‘জাতীয় সনদ’-এ অন্তর্ভুক্ত হবে এবং প্রশাসনিকভাবে সম্ভব সংস্কারগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে, এটি একটি বাস্তবধর্মী পথ। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, সংস্কারের আকার নয় বরং আইনগত প্রক্রিয়ায় নির্ভুল ও সময়োচিত বাস্তবায়নই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
‘বড় সংস্কার না হলে তাড়াতাড়ি নির্বাচন নয়’—এমন অবস্থান গ্রহণ করলে তা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। বরং আইনি ও নীতিগতভাবে যা সম্পন্ন করা সম্ভব, তা দ্রুত সম্পন্ন করে সংবিধান সংস্কারসভা ও জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা—এখন জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।
বিবৃতিতে কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্যকে ‘অযৌক্তিক’ ও ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলা হয়েছে, যা প্রকাশ্য মতবিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে। আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই সমালোচনাকে শত্রুতা মনে না করে বরং একটি গণতান্ত্রিক প্রবাহে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা—এই মনোভাবই আরও আস্থা তৈরি করতে পারে।
উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে।
কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অসাধারণ বীরত্বের মাধ্যমে মৃত্যুকে বরণ করে যারা ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করলো, তাদের একজনকেও আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হলো না।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরদের কোনো পদক দেয়া হয়নি! রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা প্রদান করা হয়নি! এমনকি আজ পর্যন্ত ৫ আগস্টকে anti fascist day বা গণঅভ্যুত্থান দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়নি! জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরদের স্মৃতিতে সম্মান জানানোর জন্য কোন লিবার্টি স্কয়ার বা গণতন্ত্র চত্বর নির্মাণ করা হয়নি! তাঁদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও বিস্ময়কর সাহসিকতায় যারা জীবন উৎসর্গ করেছে, তাঁদেরকে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান করা হয়নি! শহীদদের স্মরণে মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা স্থাপন করা হয়নি! এসব দাবি কোনো স্থাপত্যের জন্য নয় বরং সংগ্রাম-লড়াইয়ের আত্মদানের বার্তা। এসব বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষত বিবৃতির শেষাংশে বলা হয়েছে— ‘সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে’—এই বক্তব্য আশাব্যঞ্জক, তবে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট হওয়া জরুরি। জনগণকে সঙ্গে নেওয়া মানে শুধুমাত্র সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর তা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াতেই নাগরিক অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা দরকার। রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সমাজ, শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ ও মতবিনিময়ই—অন্তর্বর্তী সরকারের মূল শক্তি হতে পারে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও জনগণের সম্পর্ক নিয়ে দার্শনিকরা নানা আলোকপাত করেছেন। হান্না আরেন্ট স্মরণ করিয়ে দেন—’The most radical revolutionary will become a conservative the day after the revolution.’ একদিন যারা পরিবর্তনের অঙ্গীকারে আসে, তারাও যদি ক্ষমতার কাঠামোয় প্রশ্নহীনভাবে থেকে যায়, তবে গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ে।
কার্ল পপার বলেন—’We must plan for freedom and not only for security, if for no other reason than only freedom can make security secure.’ নিরাপত্তার নামে যদি স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, তাহলে সেই নিরাপত্তাও স্থায়ী হয় না।
জন স্টুয়ার্ট মিল আমাদের শেখান—’The worth of a state in the long run is the worth of the individuals composing it.’ একটি রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হয় তার নাগরিকদের মূল্যবোধ, সচেতনতা ও অধিকার দিয়ে—শাসনের কৌশল দিয়ে নয়।
এই মুহূর্তে রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মূল শক্তি হতে পারে—বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণ। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ—যা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও জনসাধারণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
উপদেষ্টা পরিষদের এই বিবৃতি—‘নাগরিক সংলাপ’-এর সূচনা হোক, এমনটাই আশা করা যাক। এ বক্তব্য যেনো শাসনের দলিল নয় বরং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথনির্দেশক হয়ে ওঠে।