আজকের ব্যস্ত জীবনে রান্না করে খাবার সংরক্ষণ করা, অফিসে টিফিন নিয়ে যাওয়া বা ফ্রিজে বেঁচে যাওয়া খাবার রেখে দেওয়া—এসব কাজ যেন প্লাস্টিক বক্স ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। হালকা, সস্তা, রঙিন এবং সহজে পরিষ্কার—এই “সুবিধা”র কারণেই প্রায় প্রতিটি ঘরে প্লাস্টিক কন্টেইনার এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা কি জানি, এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন এক নীরব বিষ, যা প্রতিদিন অল্প অল্প করে আমাদের শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে?
প্লাস্টিকের ভেতরের লুকানো রাসায়নিক
বেশিরভাগ প্লাস্টিক বক্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বিসফেনল এ (BPA) ও ফথালেটস নামের ক্ষতিকর রাসায়নিক। এগুলো খাবারের সংস্পর্শে এলে, বিশেষ করে গরম অবস্থায়, ধীরে ধীরে খাবারে মিশে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, BPA শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, বিশেষ করে ইস্ট্রোজেন হরমোনের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেখা দিতে পারে হরমোনজনিত অসুখ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস এমনকি বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকিও।
গরম খাবার ও মাইক্রোওয়েভ: বিষ ছড়ানোর প্রধান পথ
আমরা অনেকেই ফ্রিজে রাখা খাবার প্লাস্টিক বক্সসহ সরাসরি মাইক্রোওয়েভে গরম করি। এতে প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদান আরও দ্রুত খাবারে মিশে যায়।
ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০°C-এর বেশি তাপমাত্রায় প্লাস্টিক বক্সে থাকা খাবারে BPA-এর মাত্রা প্রায় ৫ গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে অনেকেই গরম ভাত, তরকারি বা ডাল সরাসরি প্লাস্টিকের পাত্রে রাখেন, সেটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ।
শিশুর খাবার ও দুধ রাখার পাত্রে বিপদের মাত্রা বেশি
বাংলাদেশে অনেক মা শিশুর দুধ, সিরিয়াল বা পানি রাখেন ছোট প্লাস্টিক বোতলে বা বক্সে। এটি বিশেষভাবে ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের দেহে এই বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাব অনেক বেশি, কারণ তাদের হরমোন সিস্টেম এখনো বিকাশমান। এর ফলে শিশুর বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজনন ক্ষমতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমস্যাটা আরও গুরুতর
আমাদের দেশে প্লাস্টিকের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া এখনো দুর্বল। বাজারে পাওয়া অনেক সস্তা বক্সে থাকে রিসাইক্লিং করা প্লাস্টিক, যা খাবারের সংস্পর্শের জন্য একদমই নিরাপদ নয়।
ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া অনেক অচিহ্নিত ব্র্যান্ডের পাত্রে “ফুড গ্রেড” লেখা থাকলেও তা যাচাইয়ের কোনও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নেই। ফলে সাধারণ মানুষ অজান্তেই প্রতিদিন বিষ খাচ্ছেন।
বিজ্ঞান যা বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, BPA-তে দীর্ঘমেয়াদি এক্সপোজার ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩০% পর্যন্ত বাড়ায়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH, USA) জানায়, গরম খাবার প্লাস্টিক কন্টেইনারে রাখলে খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস-এর এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ব্যবহৃত পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক বক্সের ৮০% তে স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান রয়েছে।
নিরাপদ বিকল্প কী?
প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে—
গ্লাস বা কাচের জার: খাবার সংরক্ষণে সবচেয়ে নিরাপদ, গন্ধ ধরে রাখে না।
স্টেইনলেস স্টিলের পাত্র: টেকসই, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব।
বাঁশ বা মাটির তৈরি পাত্র: প্রাকৃতিক ও প্লাস্টিকমুক্ত, গ্রামীণ ঐতিহ্যের টেকসই বিকল্প।
প্লাস্টিকের রঙিন দুনিয়া আমাদের জীবনকে যতই সহজ করুক না কেন, তার ভেতরের অদৃশ্য বিষ প্রতিদিন আমাদের সুস্থতা কেড়ে নিচ্ছে। আজই যদি আমরা ঘরের তাক থেকে ওই প্লাস্টিক বক্সগুলো সরিয়ে ফেলি, সেটিই হবে ভবিষ্যতের প্রতি এক দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত।
কারণ, স্বাস্থ্য কোনো ফ্যাশন নয়—এটাই আসল লাইফস্টাইল।